অনুৎপাদনশীল নয় উন্নয়ন প্রকল্প আবশ্যক
২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দার প্রধান কারণ ছিল আবাসন খাতে অস্বাভাবিক ঋণ বৃদ্ধি। ব্যাংকগুলো দ্রুত মুনাফা লাভের আশায় আবাসন খাতে কম সুদে এবং সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করেছিল। যদিও বিষয়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তারপরও আবাসন খাতে অনেকেই ঋণ নিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই বেকার এবং অনভিজ্ঞ ছিল। সুদের হার কম হওয়ায় অনেকেই একাধিক বাড়িও নির্মাণ করেছিল।
আবাসন খাতে বিনিয়োগ বেশি হওয়ায় সম্পত্তির বিক্রয়মূল্য অনেক কমে আসে। ফলে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে অনেকে ব্যর্থ হয়। এমন নেতিবাচক অবস্থায় আবাসন খাতে লাগাম টানার জন্য সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে আবাসন খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ কমে গিয়েছিল। অন্যদিকে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় ঋণগ্রহীতাদের সুদ পরিশোধ করা সহজ ছিল না। তাঁদের অনেকেই বন্ধক দেওয়া জমি বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে চাইলেও তা হয়ে ওঠেনি। ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দেয়। তখন রেকর্ড পরিমাণ বন্ধকীকৃত সম্পত্তি ব্যাংক কর্তৃক দখল নেওয়া হয়, যা ২০০৬ সালের তুলনায় ২২৫ শতাংশ বেশি। এমন ঝুঁকিপূর্ণ ঋণব্যবস্থা এবং আর্থিক খাতের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনাই মূলত অর্থনীতি মন্দার জন্য দায়ী। পরবর্তী সময়ে যার নেতিবাচক প্রভাব সারা বিশ্বে পরিলক্ষিত হয়।
মূলত অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে আসে, ফলে অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়। যেটা ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটেছিল। আবার এসব বিনিয়োগ বিদেশি ঋণনির্ভর হলে ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। কারণ, রাজস্ব আয়ের একটি বড় অংশ বিদেশি ঋণ পরিশোধের জন্য ব্যয় করতে হয়। রাজস্ব আয়ের বড় অংশ ঋণ পরিশোধে ব্যয় হলে একটি দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়ন কিংবা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগের সক্ষমতা কমে যায়। তাই অত্যধিক বিদেশি ঋণ আর্থিকভাবে সম্ভাবনাময় খাত এবং কর্মসংস্থানের মতো খাতগুলোতে বিনিয়োগ করার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে আর্থিক খাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়। যেমনটি আমরা শ্রীলঙ্কায় দেখতে পাই। কোভিড-১৯–জনিত কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব বিদ্যমান থাকে, যার নেতিবাচক প্রভাব শ্রীলঙ্কার ওপর বিদ্যমান থাকে। তার ওপর চীন থেকে ঋণ নিয়ে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। প্রকল্প শুরুর পর থেকেই লোকসান গুনতে শুরু করে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হাম্বানটোটায় গভীর সমুদ্রবন্দর। অন্যদিকে কলম্বোয় নির্মিত কনফারেন্স সেন্টার চালু হওয়ার পর থেকে অব্যবহৃত আছে। নবনির্মিত বিমানবন্দর তৈরিতে প্রায় ২০ কোটি ডলার খরচ হয়। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে বিমানবন্দরের বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার মতো আয়ও হচ্ছিল না। হয়তো প্রকল্পগুলোতে অর্থনৈতিক গতিশীলতা আনয়ন করতে পারলে এমনতর হতো না।
ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কিনেসের মতে, আয় ও ব্যয়ের ধারাবাহিকতার ওপরই একটি অর্থনীতি নির্ভরশীল। মানুষ আয়ের ওপর ভিত্তি করেই ব্যয় নির্বাহ করে। এতে কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটলে তবেই অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রবাহ দেখা দেয়।
অর্থনীতিতে বিদ্যমান সংকট বিবেচনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে যদি ব্যয় সংকোচন প্রবণতা তৈরি করে, তবে তা অর্থনীতিতে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই মানুষ অর্থনৈতিকভাবে রক্ষণশীল হলেও বাজারের গতিশীলতা হারিয়ে যাবে। ফলে যেকোনো সময় বাজারে ধস নেমে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হারিয়ে যাবে। তবে জিডিপি, শিল্প উৎপাদন, কর্মসংস্থান, উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ, চাকরির বাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ সূচকে সম্প্রসারণের বদলে সংকোচন দেখা দিলে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। মূলত সম্পদের যথার্থ ব্যবহার করতে মানুষ ব্যর্থ হলেই মন্দা শুরু হয়।
আমাদের দেশে শিল্প কিংবা সেবা খাতের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম উৎপাদনশীল কৃষি খাতে এখনো শ্রমশক্তির একটা বড় অংশ নিয়োজিত রয়েছে। তবে এ কথা সত্য, আমাদের দেশে নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে উঠছে। তাতে শ্রমশক্তির কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুনভাবে কর্মসংস্থানের ফলে দেশের অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে। বহু আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের ফলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থা বৃদ্ধি পাবে। দেশে সামগ্রিকভাবে ব্যবসা ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হবে। ফলে দেশে জিডিপির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
ইতিমধ্যে আমাদের দেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহ গড়ে উঠলে ২০৩০ সাল নাগাদ আনুমানিক এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। দেশের আইটি শিল্পের প্রসার ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বিভিন্ন স্থানে ২৮টি হাইটেক পার্ক/সফটওয়্যার টেকনোলজি স্থাপন করা হচ্ছে, যা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এর ফলে দেশ তথ্য ও প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে যাবে। আগামী ২০২৩ সালের মধ্যে ৫০ হাজার তরুণ-তরুণীর কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হবে।
কর্ণফুলী নদীর দুই পাড়ে সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’–এর মতো ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ হলে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে, জনগণের জীবনমানের ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। দেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রকল্পটি আগামী বছর এপ্রিল মাসে চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের ফলাফল চোখে পড়ে না, উপলব্ধি করতে হয়। যেমন শিক্ষা কার্যক্রমের প্রকল্প সরাসরি চোখে না পড়লেও উপলব্ধি করা যায়। আবার কিছু কিছু উন্নয়ন প্রকল্প আছে এর ফলাফল যুগ যুগ ধরে টিকে থাকে। যা দেশ তথা জনগণের সুদূরপ্রসারী উন্নয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাই অর্থনীতিকে সচল রাখতে উন্নয়ন প্রকল্পের ওপর জোর দিতে হবে।
অন্যদিকে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করে দিলে দেশের অর্থনীতির গতিশীলতা বন্ধ হয়ে যাবে। যার নেতিবাচক প্রভাব ১৯২৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দেখতে পাওয়া যায়। ১৯২৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া গ্রেট ডিপ্রেশনে হুবার প্রশাসন বড় বড় প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তাতে অর্থনীতির মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট ক্ষমতায় বসে বেকারত্ব দূরীকরণ এবং অথনৈতিক উন্নয়নে কাজ শুরু করে। কৃষি, শিল্প ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলো গতিশীল করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সে ক্ষেত্রে কিছু বড় প্রকল্প নতুন উদ্যমে চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রকল্পগুলোর মধ্যে কয়েকটি হলো বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, টেনেসি ভ্যালি অঞ্চলে বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মতো প্রকল্প। ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট প্রশাসনের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল। মূলত প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে নাগরিকদের কর্মক্ষেত্র তৈরি করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। প্রকল্পের মাধ্যমেই অনেক বেকার লোক সেখানে নিয়োগ পেয়েছিলেন এবং দেশের জিডিপি বাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মূলকথা হলো, ইতিবাচক অর্থনীতির জন্য উৎপাদনশীল খাতে ঋণদানে ব্রতী থাকতে হবে। অনুৎপাদনশীল খাতে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ঋণ প্রদানে বিরত থাকতে হবে। যেহেতু খাদ্য মূল্যস্ফীতিসহ সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, তাই ভোক্তাঋণের লাগাম টেনে ধরতে হবে। ব্যাংকগুলোকে অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণের প্রবাহ কমাতে হবে। এতে অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমবে। তবেই দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগের মাধ্যমে উচ্চ প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকবে।
লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট