চাঁদের বুকে ভারত, আমাদের প্রাণান্ত অভিবাদন

চন্দ্রযান-৩–এর সফল অবতরণের মধ্য দিয়ে ভারত প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের রহস্যময় দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে
ছবি: ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সৌজন্যে

খুলনার পাইকগাছা উপজেলার রাটুলি গ্রামের জন্ম নেওয়া বিশ্ববিখ্যাত রসায়নবিদ আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নামে একটা উক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ ঘোরাঘুরি করে—‘আমি ক্লাসে এত করিয়া ছাত্রদের পড়াইলাম যে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পড়িয়া চন্দ্র গ্রহণ হয়। তাহারা তা পড়িল, লিখিল, নম্বর পাইল, পাস করিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হইল, যখন আবার সত্যি সত্যি চন্দ্র গ্রহণ হইল তখন চন্দ্রকে রাহু গ্রাস করিয়াছে বলিয়া তাহারা ঢোল, করতাল, শঙ্খ লইয়া রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। ইহা এক আশ্চর্য ভারতবর্ষ।’

বাণীটি প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের কি না, সেটি তাঁর দুই খণ্ডের আত্মজীবনী ও বক্তৃতামালা থেকে যথার্থতা নিরূপণ করা যায় না। যদিও শতবর্ষ আগে এ অঞ্চলে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন বোস, মেঘনাদ সাহা এবং আমাদের সময়ের অ্যারোস্পেস সায়েন্টিস্ট এ পি জে আবদুল কালামের মতো প্রতিথযশা বিজ্ঞানীরা বিশ্বসভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছেন অনেকখানি, তবু প্রফুল্ল চন্দ্রের নামে চালু থাকা কথাগুলোই ভারতবর্ষের সাধারণে বিজ্ঞানমনস্কতার সারবত্তা। উত্তরাধুনিক যুগে এসেও ভারত যেভাবে গোমূত্র ও গোবর গবেষণায় মত্ত রয়েছে, সেই ভারত বিজ্ঞান ভোলেনি। তারা আজ চন্দ্র জয় করেছে।

অভিনন্দন ভারত। অভিবাদন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোকে। শুভেচ্ছা জানাই ইসরোর চেয়ারম্যান এস সোমনাথ ও তাঁর সতীর্থ বিজ্ঞানীদের।

‘আনন্দবাজার’ পত্রিকা জানিয়েছে, ‘ঠিক ৪০ দিনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে বুধবার চাঁদে নামল চন্দ্রযান-৩। অবতরণ করল চাঁদের কঠিনতম অংশে। যে অংশে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের মহাকাশ গবেষকেরা চন্দ্রযান নামানোর ঝুঁকি নেননি। চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে রাশিয়া। খোদ ভারতই বিফল হয়েছে চার বছর আগে। তবু হাল ছাড়েনি ইসরো। চাঁদের আঁধারে ঘেরা ‘কুমেরু’তেই দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় লক্ষ্য ভেদ করেছে। কিন্তু কিসের টানে? কেন বিপদে মোড়া চাঁদের এই দক্ষিণ মেরুতে এল ইসরো? কী আছে চাঁদের এই অংশে?

অন্ধকার, অতি শীতল (মাইনাস ৩০০°ফারেনহাইট) এবং দুর্গম এলাকা। সূর্যের আলো না-পড়া রহস্যময় এই এলাকায় আছে পাহাড় ও গিরিখাদ। আগামী দিনে পৃথিবীর বাইরে যদি কখনো মানুষের থাকার জায়গা তৈরি হয়, তবে সবার আগে দরকার হবে জল। তাই পৃথিবীর বাইরে এই একটি বস্তু হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সেই জলের সন্ধান মিলতে পারে বলে ধারণা বিজ্ঞানীদের। জল ও জমাট বাঁধা বরফ পাওয়া গেলে সেখানে মিলতে পারে অক্সিজেন ও জ্বালানি। অভিযাত্রী যান ‘প্রজ্ঞান’ মূলত সেই জল‌ খোঁজার কাজটিই করবে।

যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৯ সালে চাঁদে জলজ্যান্ত অভিযাত্রী নামালেও সেটা‌ ছিল সুমেরুতে। কুমেরুতে ২০১৯ সালেই ভারতের চন্দ্রযান-২ অভিযান‌ ব্যর্থ হয়। এমনকি‌ এই‌ সেদিন রাশিয়াও ব্যর্থ হয়েছে।

ভারতের চলতি অভিযানের প্রায় একই সময়ে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণের জন্য লুনা-২৫ নামের মহাকাশযান পাঠিয়েছিল রাশিয়া। তবে রাশিয়ার মহাকাশযানটি গত শনিবার চাঁদে বিধ্বস্ত হয়। এর মধ্য দিয়ে ৪৭ বছরের মধ্যে রাশিয়ার প্রথম চন্দ্রাভিযান ব্যর্থ হয়।

সব শঙ্কা কাটিয়ে চাঁদের বুকে সফলভাবে অবতরণ করেছে ভারতের মহাকাশযান চন্দ্রযান-৩। গতকাল বুধবার ভারতের স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৪ মিনিটে চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করে। এর মধ্য দিয়ে চাঁদে মহাকাশযান অবতরণকারী দেশের তালিকায় যুক্ত হলো ভারত।

খুব স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রার চাক্ষুষ সাক্ষী রাখতে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো) চন্দ্রযান-৩-এর অবতরণের দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করে। লাখো মানুষ এই সম্প্রচারের সাক্ষী হয়। এই উপলক্ষে দেশটির সব স্কুল খোলা রাখা হয়। এমনকি ব্রিকস সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ভার্চ্যুয়ালি ইসরোর আয়োজনে যুক্ত হন। তিনিও স্বচক্ষে নিজের দেশের চন্দ্রবিজয় দেখেন।

এর আগে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন চাঁদের বুকে সফলভাবে নভোযান অবতরণ করিয়েছে। এখন তাদের সঙ্গে চতুর্থ দেশ হিসেবে যোগ হলো ভারতের নাম। অন্যরা চাঁদের যে অংশটির নাগাল পায়নি, তা এখন ভারতের করায়ত্তে।

চন্দ্রযান-৩ চাঁদে মসৃণ ল্যান্ডিংয়ের সময় ইসরোর বিজ্ঞানীদের উচ্ছ্বাস ছিল দেখার মতো। এমন খুশি তো আর যখন-তখন আসে না। এর জন্য দরকার বিজ্ঞানের প্রতি একাগ্র প্রেম, নিষ্ঠ সাধনা, নিরন্তর গবেষণা, অপরিসীম ত্যাগ ও প্রগাঢ় ধৈর্য। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা এটা করে দেখিয়েছেন। রাজনৈতিক বিজ্ঞানীরা গোবর-গবেষক হলেও ভারতের মূলধারার বিজ্ঞানীরা যে তা নন, ইসরোর সাফল্যই এর বড় প্রমাণ।

গত ১৪ জুলাই ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান মহাকাশকেন্দ্র থেকে চন্দ্রযান-৩ উৎক্ষেপণ করা হয়। চন্দ্রযান-৩-এর ল্যান্ডারের নাম ‘বিক্রম’, রোভারের নাম ‘প্রজ্ঞান’। ল্যান্ডারটি উচ্চতায় ২ মিটারের মতো, ওজন ১ হাজার ৭০০ কেজির বেশি। আকারে ছোট রোভারের ওজন ২৬ কেজি মাত্র। ‘প্রজ্ঞান’ নামের ওই রোভারই চাঁদের বুকে ঘুরে ঘুরে বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাবে। সব ঠিকঠাক চললে সামনের দিনগুলোতে আমরা প্রজ্ঞানের প্রজ্ঞা দেখতে পাব।

আমরাও আশা করি, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান তথা স্পারসোর বিজ্ঞানীরাও একদিন চন্দ্র কিংবা মঙ্গল জয় করবেন। জানি না, আমরা ঠিক কত যুগ পর এমনটা দেখতে পাব। কত শতাব্দী পর আমাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন বিজ্ঞানবিমুখতাকে ধুয়ে দিতে পারবে আলোকময় প্রকৃত বিজ্ঞানমনস্কতা।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সংকল্প’ আজ সত্যি হলো।

‘থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে,—

কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘুর্ণিপাকে।

হাউই চড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিন পুরে;

শুনবো আমি, ইঙ্গিত কোন ‘মঙ্গল’ হতে আসছে উড়ে।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিজ্ঞান বক্তৃতায় বলেছেন, ‘যখন আমাদের মহাবিশ্ব মানুষের সাথে ঐকতানে বিরাজ করে তখন শাশ্বত, যাকে আমরা সত্য বলে জানি, হয়ে দাঁড়ায় সৌন্দর্য, আমাদের অনুভূতিতে। এ ছাড়া অন্য কোনো ধারণা থাকতে পারে না। এ জগৎ বস্তুত মানবীয় জগৎ—এর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিও হলো বিজ্ঞানী মানুষের দৃষ্টি। সুতরাং, আমাদের ছাড়া বিশ্বজগতের অস্তিত্ব নেই; এটি হলো আপেক্ষিক জগৎ, যার বাস্তবতা আমাদের চেতনার ওপর নির্ভরশীল।

রবি ঠাকুরের মানবীয় বিস্ময় ভ্রমণ আজ সত্যি সার্থক,

‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে

আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।।’