দাদির শেষ গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চাঁদনি রাত। আকাশে ঝলমলে তারা। বাড়ির উঠানে বসে রুমা তার দাদির কোলে মাথা রেখে গল্প শুনছে। দাদি গল্প বলার সময় তার কণ্ঠে এমন সুর থাকত যে রুমা মুগ্ধ হয়ে শুনত। প্রতিদিনের মতোই তারা গল্পে ডুবে ছিল।

রুমার বয়স যখন মাত্র চার, তখন থেকেই সে দাদির কাছে বড় হচ্ছে। মা-বাবা কাজের প্রয়োজনে শহরে থাকেন, তাই দাদিই রুমার সবকিছু। দাদির স্নেহমাখা হাত, মমতায় ভরা গল্প, আর রাতের আকাশে চাঁদ-তারার কথা শুনে দিন কাটত রুমার।

দাদির বয়স হয়েছিল সত্তর। বয়সের ভারে শরীর ভেঙে পড়লেও তার মমতা আর ভালোবাসায় কোনো কমতি ছিল না। প্রতি রাতেই রুমাকে নিয়ে উঠানে বসে গল্প শোনানো ছিল তাদের অভ্যাস।

সেই রাতে দাদি গল্প বলছিলেন এক রাজকন্যার, যে তার দাদির কাছে নতুন জীবন শিখেছিল। রুমা মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতে বলল,
দাদি, তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?
দাদি মুচকি হেসে বললেন,
রুমা, আমি কোথায় যাব? আমি তো তোমার সঙ্গেই থাকব, গল্পে, স্মৃতিতে।
পরের দিন ভোরবেলা, রুমা প্রতিদিনের মতো ঘুম থেকে উঠে দাদির রুমে গেল। দরজায় টোকা দিলো। কোনো সাড়া নেই।

দাদি! দাদি!

কোনো উত্তর নেই। সাধারণত দাদি ফজরের নামাজের পর তার রুমে তাসবিহ নিয়ে বসতেন। রুমা ভেবেছিল, হয়তো তাসবিহতে মগ্ন আছেন। কিন্তু কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগল।

দরজা ঠেলে খুলে দেখল, দাদি তাসবিহ হাতে নিয়ে বসে আছেন, কিন্তু নড়াচড়া করছেন না। রুমার মন ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠল। সে দৌড়ে গিয়ে দাদির হাত ধরল। দাদির হাতটা একদম ঠান্ডা।

রুমা বুঝল, তার দাদি এখন আর নেই। দাদির মুখে অদ্ভুত এক শান্তির হাসি ছিল। তাসবিহর দানাগুলো ছড়িয়ে ছিল তার পাশে। দাদি যেন তাসবিহ পড়তে পড়তেই পরপারের পথে পাড়ি জমিয়েছেন।

পুরো বাড়ি শোকে ভেঙে পড়ল। কিন্তু রুমার কান্না যেন থামতেই চায় না। তার সব গল্পের সাথি, তার সুখ-দুঃখের ভাগী, তার দাদি তাকে ছেড়ে চলে গেছেন।

সেই দিন থেকে রুমা উঠানে বসে একা একা আকাশের চাঁদ-তারার দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে মনে হয়, দাদি আকাশের তারা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। রুমা ফিসফিস করে বলে,

দাদি, তোমার সব গল্প মনে আছে। তুমি সব সময় আমার সঙ্গেই থাকবে, আমার মনে।
রুমার দাদির গল্প শেষ হয়ে গেলেও, সেই গল্প রুমার হৃদয়ে চিরজাগরুক হয়ে রইল।

  • লেখক: মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন ইবনে মোস্তাফিজ, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম।