ইদানীং জীবনযাপন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

১.

কাঠফাটা রোদে গুলিস্তান থেকে আজিমপুর যাওয়ার পথে নীলক্ষেতের জ্যামে দাঁড়িয়ে গামছায় ঘাম মুছতে মুছতে হঠাৎ রিকশাচালক প্রশ্ন করেন, ‘ভাই, জিনিসপত্রের দাম নাকি আরও বাড়ব?’
আমি তখন সহযাত্রীর সঙ্গে মগ্ন ছিলাম সান্ড্রা বুলকের নতুন মুভি ‘দ্য লস্ট সিটি’ নিয়ে আলোচনায়। আচমকা প্রশ্নবাণে সে আলোচনা হোঁচট খেয়ে থেমে যায়। জানতে চাই, কিসের দাম বাড়ার কথা বলছেন তিনি।
সবকিছুর দাম।
সবকিছুর দাম তো বেড়েই আছে।
আরও নাকি বাড়ব...চালের দাম নাকি হইবো ৫০০ টাকা।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের খবরে তেতে উঠছে বাংলাদেশ। আমাদের দেশেও কি বৈদেশিক মুদ্রার অভাব আর আকণ্ঠ ঋণের বোঝায় ওষুধ, জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের মতো সামগ্রীর অভাবে হাহাকার পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে—এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে সর্বত্র যে আলোচনার জন্ম হচ্ছে, বুঝতে পারি রিকশাচালক ভাইয়ের কানে তেমন কিছু আসার কারণেই তিনি আমার কাছে ওই প্রশ্ন রেখেছেন। আমি অর্থনীতিবিদ নই। এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা নেই। তবে পত্রিকায় জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ কম হওয়ার পাশাপাশি অর্থনীতির আকারের তুলনায় সরকারের আয়ও যে কম, তা পড়ার পর আমারও কপাল কুঁচকেছে। তবু যেকোনো বিপদে বাংলাদেশের মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি, বর্তমান পরিসংখ্যানভিত্তিক তথ্য এবং সংসদে প্রধানমন্ত্রীর আশাবাদী বক্তব্যের ওপর ভরসা রেখে আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলি, অমন কিছু বাংলাদেশে হবে না। হয়তো জিনিসপত্রের দাম আরও কিছুটা বাড়বে, কিন্তু চালের দাম ৫০০ টাকায় পৌঁছানোর মতো অবস্থা হওয়ার ভয় বাতুলতা। সঙ্গে হেসে এ–ও যোগ করি—
আরও দাম বাড়লে সমস্যা কী? এখন যেমন গুলিস্তান থেকে আজিমপুরের ৭০ টাকার ভাড়া বেশি নিচ্ছেন ৫০ টাকা, তখন বেশি নেবেন ১০০ টাকা...আপনাদের তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
শুনে রিকশাচালকও হেসে দেন। তারপর একটু ভেবে বলেন, আরও দাম বাড়লে দেশে যামু গা। খেতি করমু।
দেশের বাড়ি কোথায় আপনার?
ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
জমিজমা কেমন আছে?
আছে ভালোই...৪ কানির মতো হইব।
মনে মনে আঞ্চলিক জমির মাপ কানিকে শহুরে কাঠায় রূপান্তরের হিসাব করতে গিয়ে আমার চোখ অদৃশ্যভাবে কপালে উঠে যায়।
এত জমি থাকতে রিকশা টানার কাজ করেন কেন?
জমিতে নগদ পয়সা কম, খাটুনি বেশি। তয় ঠেকায় পড়লে সমস্যা নাই। খেতি কইরা চইলা যাইব।
গ্রীষ্মের রোদে অমানবিক এক শহরের রিকশায় বসে আমি বিব্রত হই এক ধনী রিকশাচালকের রিকশায় বসে থাকতে। ভাবি, আমরা যারা পুথিগত পড়াশোনা, কয়েক বছরের চাকরি অভিজ্ঞতা থাকায় একটা চাকরির কান মলে ‘ওপর দিয়ে ফিটফাট, ভেতর দিয়ে সদরঘাট’ ধরনের ধার করে ঘি খাওয়া অভ্যস্ত জীবনযাপনে মজে আছি, ঠেকায় পড়লে কী করব?

২.

ছুটির দিনগুলোয় বিকেলবেলা আমার সহধর্মিণী ও আমি প্রায়ই হাঁটতে বের হই। পৈতৃক সূত্রে আমার এবং আমার সূত্রে তার—দুজনেরই বসবাস নারায়ণগঞ্জের না-শহর, না-গ্রাম এক এলাকায়, যাকে আবার ঠিক মফস্‌সলও বলা যায় না পুরোপুরিভাবে। ঘোরার জায়গা বলতে হাঁটার দূরত্বে শীতলক্ষ্যা নদী, দুই টাকা করে পারানিতে যার অপর পাড়ে গেলে সাদা বালু ফেলা বিস্তীর্ণ এক খোলা জায়গা আছে, এর নাম আমরা দিয়েছি সেন্ট মার্টিন।

ফাইল ছবি

এ এলাকার বাজারগুলোতেও আমরা কখনো কখনো ঘুরতে যাই। লাউ, পুঁই শাকের ডগা উঁকি দিয়ে থাকা চটের ব্যাগ হাতে মানুষের ছোটাছুটি, প্রাণচাঞ্চল্যের অংশ হতে ভালোই লাগে। তখন অকারণ কেনাকাটাও করা হয় বেশ।অকারণ এ কেনাকাটার জন্য আমার স্ত্রী খুঁজে খুঁজে বের করে আনাজপাতির বয়োবৃদ্ধ বিক্রেতাদের। তাঁদের সঙ্গে সে কখনো দামাদামি করে না। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংকুচিত হয়ে থাকা এসব মানুষের অধিকাংশেরই চোখে থাকে ভারী ঘোলাটে চশমা, যা তাঁর ছানি পড়তে থাকা দৃষ্টিকে প্রসারিত করে, নাকি ঘোলাটে করে, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তাঁদের কেউ হয়তো নিয়ে বসেছেন ছোট এক ঝুড়ি বাতাবি লেবু, কিছু ধনেপাতা, কয়েক কেজি আমড়া, পেয়ারা, নয়তো দু–এক কাঁদি চম্পা কলা।

নিজের পসরা নিয়ে তাঁরা বাজারের এক কোণে পড়ে থাকেন। অন্য বড় বিক্রেতাদের মতো তাঁরা কখনোই হাঁকডাক করে ক্রেতা ডাকেন না। জীবনযুদ্ধে তাঁরা যেন এমন সৈনিক, যাঁরা বহু আগের কোনো যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিয়েছেন; পথ ভুলে পেছনে রয়ে গেছে কেবল তাঁদের ছায়া।

দাম বাড়লে সমস্যা কী? এখন যেমন ভাড়া বেশি নিচ্ছেন, তখন বেশি নেবেন...আপনাদের তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। শুনে রিকশাচালকও হেসে দেন। তারপর একটু ভেবে বলেন, আরও দাম বাড়লে দেশে যামু গা। খেতি করমু।

আজ যাঁকে পাওয়া গেল, তাঁর বয়স আশিরও বেশি। শীর্ণ শরীর, ভাঙা লম্বাটে মুখ, রগ–ওঠা হাত। তাঁর থেকে নেওয়া গেল এক কেজি আমড়া আর ছোট একটা লাউ। তিনি দাম চাইলেন মাত্র ৯০ টাকা। তাঁর কাছে দাঁড়িপাল্লাও নেই, মাপতে হলো পাশের দোকানে।
কোটি কোটি টাকার ফ্ল্যাট, বিলাসবহুল গাড়ি কেনার ঋণের মহাজনি করতে করতে সংখ্যার সঙ্গে আমার কিছুটা হৃদ্যতা আছে। মনে মনে হিসাব করে দেখলাম, তার পুরো দোকানের চালানের দাম হাজারখানেকও হবে না।

অনভ্যস্ততায় জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, তিনি আর কিছু করেন না। পারেন না, কারণ এ বয়সে শরীরে আর কুলোয় না। ভোরে বের হয়ে বড়বাজার থেকে মাল কেনেন আর বিকেলে সেসব বিক্রি করেই তাঁর জীবন-জীবিকা। সংসারে তিনি আর অসুস্থ স্ত্রী। আমার চেয়েও বয়সী তাঁর দুজন সোমত্ত ছেলেও আছে বটে, তবে তারা মা–বাবার কোনো খোঁজ রাখে না আজ বছর পাঁচেক। কেমন আছেন—এ প্রশ্নের জবাব তিনি হেসে বলেন, ভালো আছেন। আল্লাহ চালিয়ে নিচ্ছেন। ভিক্ষা তো করা লাগছে না। আলহামদুলিল্লাহ।

কিছু টাকা বেশি দিতে চাইলে তিনি হাসিমুখে ফিরিয়ে দেন। ‘বাবা’ সম্বোধনে বলেন বরং দোয়া করতে, আল্লাহ যেন ভালোয় ভালোয় দুনিয়া থেকে তুলে নেন। তাঁর নির্মোহ ব্যক্তিত্বের সামনে আমি নতজানু হই...মাথায় হিসাব কষি, এই দুর্মূল্যের বাজারে তিনি কীভাবে বেঁচে আছেন? হিসাব মেলে না।

ইচ্ছা করে, যৎসামান্য এই বিক্রি শেষে তিনি যখন রাতে শ্রান্ত শরীরে অন্ধকার হাতড়ে বাড়ির পথ ধরবেন, পিছু পিছু তাঁর মাথা গোঁজার আশ্রয়ে যাই। লুকিয়ে থেকে একটু দেখি, তাঁরা দুজন টিমটিমে আলোয় কী দিয়ে রাতের খাবার খান। দেখি তাঁদের এত বছরের সংসারের ঘরটাতে কী কী আছে? কান পেতে শুনি, দীর্ঘ সময় পর দেখা হওয়ার পর তাঁরা একে অপরের সঙ্গে কী নিয়ে কথা বলেন, জীবনের শেষবেলায় তাঁরা কী ভাবেন পরের দিনটাকে নিয়ে?

যাদের সব থেকেও দিনরাত না থাকার দীর্ঘশ্বাস, অনেকের থেকে বেশি থাকার পরও আরও অর্থবিত্তের জন্য জিবের লালা ঝরানো কুৎসিত লোভ, সেই গোত্রের একজন আমি ফেরার পথে ভাবি, জীবনে এত অল্পেও কি তবে সন্তুষ্টি নিয়ে বাঁচা যায়?
এমনকি ধৃষ্টতাও দেখানো যায় অবলীলায় ‘ভালো আছি’ বলার, যা সুখের অসুখে ভোগা আমরা অনেকে চাইলেও পারি না?

লেখক: বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী