শিক্ষকদের মূল্যায়ন ও দক্ষতা উন্নয়ন: শিক্ষাব্যবস্থার রূপান্তরের চাবিকাঠি
জীবন একটা প্রবহমান নদীর মতো। জোয়ার–ভাটা থাকবে। যদি থেমে যায়, তার পরিণতি হলো মৃত্যু। একজন শিক্ষকের জীবন তার ব্যতিক্রম নয়। জীবনে সব সময়ই শেখার পেছনে লেগে থাকতে হয়। একজন শিক্ষকের উচিত নিয়মিতভাবে ভ্যালু অ্যাড করতে থাকা। নতুন কিছু যোগ করা। নিজের দক্ষতাকে বাড়ানো। একবার একটা চাকরি পেয়ে গেলাম, শিক্ষক হয়ে গেলাম আর ক্লাসে গিয়ে শুধু লেকচার দেব—বিষয়টা এমন নয়। শিক্ষার্থীদের নতুন জ্ঞানের দ্বার উন্মোচন করা এটা একজন শিক্ষকের কর্তব্য।
আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বিজনেস স্টাডিজ বিভাগের ডিন ও বর্তমান শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন বলতেন, শিক্ষকের কাজ তিনটি—১. জ্ঞান আহরণ, ২. জ্ঞান বিতরণ ও ৩. নতুন জ্ঞান অন্বেষণ।
একজন শিক্ষকই পারেন একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে। এ বাণীটি আমরা প্রায়ই শুনলেও বাস্তবে শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন ও দক্ষতা উন্নয়নের বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে যায়। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন শিক্ষকদের পেশাগত মানোন্নয়ন। কিন্তু শুধু প্রশিক্ষণই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন সামগ্রিক মূল্যবোধের রূপান্তর। এই নিবন্ধে শিক্ষকদের ভ্যালু অ্যাড ও দক্ষতা উন্নয়নের বহুমাত্রিক দিকগুলো বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।
বর্তমান বাস্তবতা
বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশার বর্তমান চিত্র বেশ জটিল। একদিকে যেমন কিছু শিক্ষক অসম্ভব নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে পেশাগত বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা তাঁদের কাজকে বাধাগ্রস্ত করছে। অনেক শিক্ষকই প্রশিক্ষণের অভাবে পুরোনো পদ্ধতিতেই পড়া চালিয়ে যান। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা আরও নাজুক, যেখানে অত্যন্ত কম বেতনে, অনিয়মিত চাকরি ও সামাজিক স্বীকৃতির অভাব শিক্ষকদের মনোবল ভেঙে দেয়। ফলস্বরূপ মেধাবী শিক্ষার্থীরা আর শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় ক্যারিয়ার হিসেবে দেখছে না।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে করণীয়
শিক্ষকদেরই এগিয়ে আসতে হবে জ্ঞানার্জনের অফুরান যাত্রায়। বর্তমান ডিজিটাল যুগে Coursera, edX, Khan Academy, মুক্তপাঠ–এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো বিশ্বমানের শিক্ষা গ্রহণের অসীম সুযোগ দিচ্ছে। শুধু বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান নয়, শিক্ষাদানের আধুনিক পদ্ধতিগুলো রপ্ত করতে হবে। ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং, প্রবলেম সলভিং ও সৃজনশীলতা বিকাশের মতো দক্ষতাগুলো ক্লাসরুমে প্রয়োগ করতে শিখতে হবে। প্রতিদিনের শিক্ষণ কার্যক্রম নিয়ে রিফ্লেক্টিভ প্র্যাকটিস বা চিন্তনীয় অনুশীলনের মাধ্যমেই খুঁজে বের করতে হবে উন্নয়নের ক্ষেত্রগুলো।
ডিজিটাল লিটারেসি বা সফট স্কিল আয়ত্ত করতে হবে, যেমন মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশন (পিপিটি), ফটোশপ, অ্যাডভান্স লার্নিংয়ের ক্ষেত্রে কোডিং, এইচটিএমএল ও গ্রাফিক ডিজাইন শেখা যায়।
মুঠোফোনে গুগলের যত সার্ভিস আছে, সব ফাংশন জানতে হবে। বিশেষ করে ই–মেইলিং, গুগল ডকস, গুগল ড্রাইভ, গুগল ম্যাপস ও গুগল ক্যালেন্ডারের ব্যবহার জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা শিখতে হবে। বাংলা ও ইংরেজি দুটিই। শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ, ইংরেজির ফোনেটিকসগুলোর সঠিক উচ্চারণ জানা উচিত। দেখবেন যে আপনি কথা বললে, কথা থেকে মুক্তা ঝরবে।
একজন শিক্ষকের অন্যতম কাজ হলো গবেষণা করা। ভাবতে শেখা, সমস্যা সমাধান করা। এ ক্ষেত্রে আমরা খুবই পিছিয়ে। একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়া আর অন্য কেউ তেমন একটা গবেষণা করতে চান না। এখন সরকারি কলেজের শিক্ষকেরা অনেকেই এগিয়ে আসতেছেন। কেউ কেউ এমফিল ও পিএইচডি করতেছেন।
প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি। শুধু মাসিক বেতন দিয়েই দায়িত্ব শেষ নয়; বরং শিক্ষকের সার্বিক বিকাশের দায়িত্বও প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে। নিয়মিত পেশাগত উন্নয়ন ওয়ার্কশপ, পিয়ার লার্নিং সেশন ও এক্সপার্টদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য ক্যারিয়ার ল্যাডার বা পেশাগত সিঁড়ির ব্যবস্থা করতে হবে, যেখানে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পদোন্নতি মিলবে। শিক্ষকদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় অংশীদার করতে হবে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
সরকারি পদক্ষেপ
রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রয়োজন কিছু মৌলিক সংস্কার। প্রথমত, শিক্ষক নিয়োগে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা ও মেধাভিত্তিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য কনটিনিউয়াস প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট (সিপিডি) বা ধারাবাহিক পেশাগত উন্নয়ন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তৃতীয়ত, টিকিউআই–এসইপি ও নেপের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে সারা দেশের শিক্ষকদের কাছে মানসম্মত প্রশিক্ষণ পৌঁছে দিতে হবে। সর্বোপরি, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে শিক্ষকদের আকর্ষণীয় বেতনকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে।
সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
শিক্ষকদের মূল্যায়ন শুধু আর্থিক নয়, সামাজিক স্বীকৃতির বিষয়ও বটে। অভিভাবকদের উচিত শিক্ষকের সঙ্গে সমন্বয় করে সন্তানের শিক্ষণপ্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া। মিডিয়ার দায়িত্ব শিক্ষকদের সাফল্যের গল্প প্রচার করে পেশাটিকে গৌরবান্বিত করা। জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষক দিবসে গুণী শিক্ষকদের পুরস্কৃত করার মাধ্যমে তাঁদের কাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো।
সফলতার উদাহরণ
ফিনল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা সফল হওয়ার পেছনে বড় কারণ, শিক্ষকদের উচ্চ মর্যাদা ও নিয়মিত দক্ষতা উন্নয়ন। ফিনল্যান্ডে শিক্ষকতা অন্য পেশাগুলোর মধ্যে একটি। সিঙ্গাপুরে শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত ১০০ ঘণ্টা পেশাগত উন্নয়ন প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যেমন ব্র্যাক তাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে।
শিক্ষকদের মূল্যায়ন ও দক্ষতা উন্নয়ন কোনো বিলাসিতা নয়; বরং জাতীয় অগ্রগতির অপরিহার্য শর্ত। শিক্ষক, প্রতিষ্ঠান, সরকার ও সমাজ সবাইকে সমন্বিতভাবে অংশ নিতে হবে। এটি একটি বিনিয়োগ, যার প্রভাব পড়বে আমাদের সন্তানদের ওপর। একজন শিক্ষকের মানোন্নয়নই আগামী দিনের উন্নত বাংলাদেশের ভিত্তি।
*লেখক: ফয়সাল হাবিব, প্রভাষক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বাঞ্ছারামপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ