শিক্ষক হোক শিক্ষার্থীবান্ধব

প্রত্যেক ছেলেমেয়ের কাছে মা-বাবার পর সম্মানের স্থানে থাকেন শিক্ষক বা তার গুরুজন। একজন শিক্ষককে মা-বাবার সমতুল্য করে দেখা হয়। শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রত্যেক ছেলেমেয়ের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় পরিবার থেকে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা নেওয়ার জন্য সবাইকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারস্থ হতে হয়। যেখানে সবার অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সেই প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত শিক্ষক-শিক্ষিকা। তাঁরা আমাদের শেখান, কীভাবে একজন প্রকৃত মনুষ্যত্বসম্পন্ন মানুষে পরিণত হওয়া যায়। আমাদের আচার-আচরণ কেমন হওয়া উচিত। বয়সভেদে কাকে কীভাবে সম্মান, স্নেহ করা উচিত। মূলত জাতি গড়ার কারিগর তাঁরাই।

একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব লোক নিয়োগ দেওয়া হয়, তাঁদের প্রধান কাজ হলো শিক্ষার্থীদের মঙ্গলে কাজ করা। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজে ব্যবহার করছেন। তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তৈরি করছেন বাসাবাড়িতে, হলের ডাইনিং বন্ধ রেখে আয়োজন করছেন মেয়ের গায়েহলুদের। প্রতিষ্ঠানের পানির লাইন কিংবা বিদ্যুৎ ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহার করে তাঁদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছেন মোটা অঙ্কের টাকা। সুযোগ পেলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিটি অংশ ব্যবহার করা হচ্ছে নিজের স্বার্থ হাসিলের কাজে। প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মন জয় করে, কীভাবে বেতন-ভাতা বাড়ানো যায়। শিক্ষার্থী বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো ধরনের উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার যেন সময়েই নেই তাঁদের কাছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেন চাকরি নেন বাধ্য হয়ে। জীবন পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন তা-ই। শেখানোর নেশা যেন সবার মধ্যে থেকে বিলীন হয়ে গেছে।

একজন দক্ষ শিষ্য গড়ে তোলার ইচ্ছাই যেন আর নেই। শিক্ষার্থীদের বিপদে একজন শিক্ষকের যেমন ঘুম হারাম হয়ে যেত, আজ যেন তা কল্পনা। শিক্ষক ছাত্রকে চেনেন না, ছাত্র শিক্ষককে চেনে না। শিক্ষক-ছাত্রের যে মধুর সম্পর্ক, তা আজ বিলীন। স্কুল-কলেজপর্যায়ের কমিটি এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন খাতায় তাঁদের নাম লিপিবদ্ধ করে দায় সেরেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কিছুই যেন করার নেই তাদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় কমিটি, প্রশাসনের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী। যাদের জন্য এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তাদের যেন কোনো মূল্যই নেই কমিটি, প্রশাসনের কাছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না দেওয়া হলেও অর্থ আদায়ে একটুও দেরি করে না তারা। একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান নিয়মকানুন অবশ্যই শিক্ষার্থীবান্ধব হওয়া উচিত। প্রত্যেক শিক্ষার্থী কী চায়? কোনো পদ্ধতি সংযোগ বা বিয়োজন করলে শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো ক্লাস করবে এবং ভালো ফল করবে, এসব বিষয় নির্ধারণ করার জন্য অবশ্যই শিক্ষার্থীদের মতামত নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দেখতে পাই, যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রতিবছর প্রচুর ছাত্রছাত্রী ভর্তি হওয়া সত্ত্বেও ক্লাসে শিক্ষার্থীসংকট। কেন এমন হয়, একবার কি ঠান্ডা মস্তিষ্কে ভেবে দেখেছেন? যদি আমি এ সম্পর্কে বলি, তাহলে আমার উত্তর হবে এমন, কেনই-বা থাকবে। প্রত্যেক মানুষ চায় নতুনত্বের সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করতে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস চলাকালীন অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকা একাডেমিক পাঠ্যপুস্তক থেকে লাইন বাই লাইন রিডিং পড়ে যান, যা খুবই বিরক্তিকর। ঢাকা শহরের মতো স্থানে জ্যাম ঠেলে এসে অর্থদণ্ড দিয়ে যদি সেই বই রিডিং পড়তে হয়, তবে তো বাসায় বসে সুস্বাদু খাবার খেয়ে একটা গভীর ঘুম দিয়ে উঠে একটানা দুই থেকে চার ঘণ্টা পড়াই উত্তম। কেন সময় অপচয় করে, বিরক্তিকর জ্যাম ভোগ করে, অর্থদণ্ড দিয়ে ক্লাস করা। তার থেকে বাসায় বসে সুন্দরভাবে পড়ালেখা চালিয়ে গিয়ে, পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিলেই হয়। পরীক্ষার হলে আবার স্যার-ম্যামদের বাসাবাড়ির আলোচনা—কোন তরকারিতে লবণ কম হয়েছে, কার স্বামী কত বড় পোস্টে চাকরি করেন, কোনো সহকর্মীর ব্যবহার ভালো নয়, কার মেয়েকে কীভাবে স্কুলে দিয়ে আসা হলো, কার মেয়ে খাবার খেতে চায় না, কার আত্মীয় কোথায় কী করছে ইত্যাদি, যা সত্যি বলতে অসহ্য। মাঝেমধ্যে মনে হয়, তাঁরা কি আদৌ কোনো সময়ে শিক্ষার্থী ছিলেন? শিক্ষার্থীদের ভালো লাগা, খারাপ লাগার বিষয়গুলো তাঁরা বুঝতে পারেন না। পরীক্ষার হলে বসে উচ্চ স্বরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কেচ্ছাকাহিনি, গল্প আর হাসাহাসিতে মেতে ওঠেন তাঁরা, যা পরীক্ষার হলে থাকা প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর জন্য একটা বিরক্তিকর অধ্যায়।

তাই পরিশেষে জোর দিয়ে একটা কথা বলতে চাই, সুন্দর জাতি গঠনে শিক্ষকদের বিকল্প নেই। এর জন্য তাঁদের অবশ্যই শিক্ষার্থীবান্ধব হতে হবে।
*লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ