৫৭ বছরের গৌরবময় পথচলায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, নামটি শুনলেই চোখে ভেসে উঠে শাটল ট্রেন, দেশের সর্ববৃহৎ ও সবুজ পাহাড়ে আবৃত এক নৈসর্গিক ক্যাম্পাসের কথা। এবার গতকাল শুক্রবার (১৮ নভেম্বর) ৫৬ পেরিয়ে ৫৭ বছরে পা রাখে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বাংলাদেশের অদ্বিতীয় ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি সাফল্য, গৌরব আর ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেকে করেছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দুই যুগের সাক্ষী। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জ্ঞানের প্রদীপ জ্বেলে চলেছে। তৈরি করেছে দেশের অসংখ্য জ্ঞানী ও গুণীর। দেশ ও জাতির ক্রান্তিলগ্ন সর্বদা সোচ্চার থেকেছে এ বিদ্যাপীঠ। উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো দেশের গণতন্ত্র বিনির্মাণ, অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক সত্তার বিকাশ, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা ও দেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার পূরণে অপ্রতিহত অবদান রেখে চলেছে।

১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার উত্তরে হাটহাজারী উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের জোবরা গ্রামে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এর পর থেকে প্রতিবছর ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। শুরুতে ৮ জন শিক্ষক, ৪টি বিভাগ এবং ২০৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির পথচলা শুরু হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থী, দেশ ও দেশের বাইরে সুনাম অর্জনকারী ৯ শতাধিকের গুণী শিক্ষক রয়েছেন। বর্তমানে ৯টি অনুষদের অধীন ৪৮টি বিভাগ ও ৬টি ইনস্টিটিউট রয়েছে।

৫৭ বছরের পথচলায় বিশ্ববিদ্যালয়তে পদচারণ করেছে দেশের অসংখ্য জ্ঞানী ও গুণীর। উপমহাদেশে প্রখ্যাত ভৌত বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবদুল করিম, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক অনুপম সেন, শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান, জাতীয় অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসানসহ আছেন অসংখ্য জ্ঞানী, গুণী, বরেণ্য ও কীর্তিমান মনীষী পদচারণ। শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয়টির যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার থেকে শুরু করে গিনেস বুকেও নিজেদের নাম লিখে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীরা। এত গৌরব, সাফল্য অর্জনের পরও বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতি শিক্ষার্থীদের কিছু আক্ষেপ থেকেই যায়।

বিশ্বের একমাত্র শাটল ট্রেনসমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। এ শাটল ট্রেনকে ঘিরে হাজারো শিক্ষার্থীর সুখ-দুঃখের গল্পগাথা আবর্তিত হয়। শহর থেকে ক্লাস করতে আসা শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে ১৯৮৮ সাল থেকে শাটল ট্রেনের চলাচল শুরু হয়। শাটল যাত্রার তিন যুগে পৌঁছেও পুরোনো বগি ও ঝুঁকিপূর্ণ রেললাইনের পরিবর্তন হয়নি; বরং হারিয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেমু ট্রেনটিও। গাদাগাদি আর হাঁসফাঁস মধ্য দিয়েই বাধ্য হয়ে শাটল ট্রেনে চলাচল করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে থেকে নতুন ট্রেন, বগি বৃদ্ধিসহ কিছু আশার কথা শোনা যায়, কিন্তু তা কবে বাস্তবে রূপ নেবে, কেউ জানে না। এ ছাড়া বর্তমানে শাটল ট্রেনে নিরাপত্তা নিয়েও আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা। ব্যাগ, মুঠোফোন চুরি, চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ এখন নিত্যদিনের ঘটনা।

শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ১৪টি আবাসিক হল ও ১টি ছাত্রাবাস। এর মধ্যে ৯টি ছেলেদের ও ৫টি মেয়েদের হল। মাত্র ১৯ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী আবাসিক সুবিধা পান। আবাসিক শিক্ষার্থীরা নিম্নমানের অস্বাস্থ্যকর খাবার, পানির সমস্যা, বাথরুম সংস্কার ও মেরামতসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত। পাঁচ বছরেও শেষ করতে পারেনি চবির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নির্মাণকাজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র চারবার। প্রতিষ্ঠার পর চাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র ছয়বার। ২৯ বছর ধরে হয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন। দেশের সর্বত্র ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লাগলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং কার্যক্রম এখনো চলছে অ্যানালগ পদ্ধতিতে। এ কারণে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। ঘণ্টা পর ঘণ্টা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ব্যাংকিং কার্যক্রম। কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে বই আছে তিন লক্ষাধিক। কিন্তু শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় বইয়ের সংখ্যা সীমিত। লাইব্রেরিতে বাইরে থেকে পছন্দমতো বই নিয়ে পড়া যায় না। ক্যাটালগ পিসি প্রায়ই নষ্ট থাকে। ফলে দিন দিন লাইব্রেরিবিমুখ হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

এত কিছুর সত্ত্বেও আক্ষেপের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে শিক্ষার্থীদের প্রাপ্তি অজস্র। শিক্ষার্থীদের আক্ষেপের জায়গাগুলো পূরণ করার জন্য প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সুনজর। আশা করছি, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুকূল দৃষ্টি পড়বে। সর্বোপরি, গবেষণা ও উচ্চশিক্ষায় দেশ ও জাতির পথপ্রদর্শক হোক প্রাণের বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়—এমনটাই প্রত্যাশা করছি।

লেখক: মো. সাইফুল মিয়া, শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।