ভারত–পাকিস্তান সংঘাত: যুদ্ধে পুড়বে বিবেক, হেরে যাবে মানুষ
মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে পাকিস্তানের কোটলি, ভাওয়ালপুর, মুরিদকে, বাগ ও মুজাফফরাবাদে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ভারত। কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর প্রতিশোধপরায়ণ ভারতের এই হামলা ‘কাপুরুষোচিত’ বলে আখ্যা দিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পাল্টা জবাবে পাকিস্তানও নেমে পড়েছে যুদ্ধের ময়দানে।
পাকিস্তানের আইএসপিআরের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ভারতের এ আগ্রাসনের জবাব তাঁরা দিতে শুরু করেছেন। ভারতীয় রাফাল, মিগ-২৯ ও সু-৩০সহ পাঁচটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা হয়েছে।
একেকটি বিমান ধ্বংস মানে কেবল প্রযুক্তির বিপর্যয় নয়, প্রতিটি ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমানের পেছনে রয়েছে একেকটি পরিবারে চিরস্থায়ী শোকের ছায়া। অর্থের হিসাবে হয়তো তা কয়েক শ কোটি ডলার, কিন্তু প্রাণের দামে তা অননুমেয়।
ফ্রান্স থেকে ৭৪০ কোটি ডলারে ২৬টি রাফাল কেনার চুক্তি করেছে ভারত। এই মুহূর্তে তাদের কাছে ৩৬টি রাফাল রয়েছে। অথচ একটি বিমান ধ্বংস হওয়া মানে হলো মুহূর্তেই প্রায় ২৮ কোটি ডলার ছাই হয়ে যাওয়া। কিন্তু তার চেয়েও বেশি মূল্যবান সেই বিমানের পাইলট—যাঁর জন্য হয়তো অপেক্ষা করছিলেন সন্তান, সঙ্গিনী, মা কিংবা বৃদ্ধ পিতা।
আর যেখানটা বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়, সেখানে যুগের পর যুগ চলতে থাকে চিরায়ত কান্না।
পৃথিবী এখন যুদ্ধের ভারে নুয়ে পড়ছে। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস বলছে, এ মুহূর্তে বিশ্বে ৫৬টি স্থানে যুদ্ধ চলছে। কিন্তু এই পরিসংখ্যানের চেয়েও ভয়াবহ সত্য হলো, দারিদ্র্য ও জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত দক্ষিণ এশিয়া আর কোনো যুদ্ধের ধাক্কা নিতে প্রস্তুত নয়।
ভারত-পাকিস্তানের এই উত্তেজনা যদি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ নেয়, তাহলে বাংলাদেশকেও চরম খেসারত দিতে হতে পারে।
প্রথমত, যুদ্ধের অভিঘাতে বাংলাদেশে সৃষ্টি হবে গভীর অর্থনৈতিক সংকট। ভারতের সঙ্গে সরবরাহনির্ভর কাঁচামাল, জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের আমদানি ব্যাহত হবে, শিল্প উৎপাদন স্থবির হয়ে পড়বে। রপ্তানি বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে, মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী হবে, শেয়ারবাজারে ধস নামবে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন।
দ্বিতীয়ত, সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলগুলোতে উদ্বাস্তুদের ঢল নামতে পারে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এই অস্থিরতার সুযোগে উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।
তৃতীয়ত, কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এক জটিল ভারসাম্যের দোলাচলে পড়বে—একদিকে প্রতিবেশী ভারত, অন্যদিকে পাকিস্তান ও বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বের প্রতি জনমানসের আবেগ ও সহানুভূতি। এই নাজুক ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হবে।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: ns@prothomalo.com
যদি চীন, যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়ার মতো পরাশক্তি এই যুদ্ধকে ঘিরে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে, তাহলে তা রূপ নেবে এক ভয়ংকর আন্তর্জাতিক সংকটে, যার প্রভাব কেবল রণাঙ্গনেই নয়, পৌঁছে যাবে আমাদের প্রতিটি ঘরে। ব্যাহত হবে পণ্য পরিবহন, থমকে যাবে চলাচল, বাড়বে নিরাপত্তা শঙ্কা, স্থবির হবে উন্নয়ন।
এই যুদ্ধের শেষ কোথায়, কেউ জানে না। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই যুদ্ধে বিজয়ী হবে না কেউই। পরাজিত হবে কেবল মানুষ, তার জীবন, তার স্বপ্ন ও তার ভবিষ্যৎ।
শিল্পী বব ডিলানের কণ্ঠে ধ্বনিত হওয়া প্রতিবাদী গান 'Masters of War'-এর লাইনগুলো যেন আজ আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে—
You fasten the triggers
For the others to fire,
Then you sit back and watch
When the death count gets higher...
You hide in your mansion
While the young people's blood
গুলিটা ছোড়ে অন্য কেউ,
তারপর পেছনে বসে দেখো
মৃতের সংখ্যা বাড়ে কেবলই...
তুমি আড়ালে থাকো তোমার প্রাসাদে,
যখন তরুণদের রক্ত ঝরে পথে।
তোমরা বোঝো না জীবনের মূল্য,
ভয় পাও না মৃত্যুকে,
তোমার অর্থ-ক্ষমতা কিনে দেয় মিথ্যা নিরাপত্তা।
তবু একদিন পৃথিবী হিসাব চাইবেই।
তোমরা ধ্বংস করো যা কিছু সুন্দর,
গুঁড়িয়ে দাও স্বপ্ন, হত্যা করো ভবিষ্যৎ—
তবু মুখে নৈতিকতার মুখোশ পরো।
আমরা চাই না সেই দিন ফিরে আসুক, যেখানে আকাশে পরমাণু মেঘ, মাটিতে কেবল ছিন্নবিচ্ছিন্ন মানবদেহ। আমরা চাই না দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি ঘরে হিরোশিমার অঝোর কান্না। আমরা আশায় বাঁচি—যুদ্ধ থেমে যাবে। বিবেক জেগে উঠবে। মানুষ জিতবে।
লেখক: সাংবাদিক
৭ মে ২০২৫