আজ ৫ অক্টোবর—বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিনে আমি আমার জীবনের সব শিক্ষককে, যাঁদের কাছে আমি পড়েছি, তাঁদের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। অভিনন্দন জানাই সেই সব শিক্ষককে, যাঁরা সমাজ পরিবর্তনের কারিগর হিসেবে আগামী প্রজন্মকে গড়ে তোলার মহৎ দায়িত্ব পালন করছেন।
শিক্ষক ছাড়া জ্ঞানের আলো শিশুদের কাছে পৌঁছায় না। শিক্ষক ছাড়া আমাদের সন্তানদের দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করা অসম্ভব। শিক্ষক তাঁর মেধা, শ্রম ও ত্যাগের মাধ্যমে জাতির অতীতকে জ্ঞানভিত্তিক করে তুলেছেন এবং বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে আলোকিত করছেন। জাতি গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আমরা প্রায়ই শিক্ষকদের নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনা করি, আজকের শিক্ষকদের অতীতের শিক্ষকদের সঙ্গে তুলনা করি। কিন্তু একটি প্রশ্ন আমরা প্রায়ই এড়িয়ে যাই: শিক্ষকতা পেশায় কারা আসবেন, তা নির্ধারণের দায়িত্ব কার? এর উত্তর একটাই—রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র যদি শক্ত মানদণ্ড স্থাপন করে এবং যথাযথ বেতনকাঠামো নিশ্চিত করে, তবে মেধাবীরা এখনো এই পেশাকে বেছে নেবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্র এই পেশাকে ‘যেভাবে চলছে চলুক’—এই মনোভাব নিয়ে পরিচালনা করছে। এভাবে শিক্ষার মানোন্নয়ন বা শিক্ষকের মর্যাদা কোনোটিই নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
শিক্ষকতা বলতে কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাই বোঝায় না। প্রকৃত শিক্ষা গড়ে ওঠে তৃণমূল পর্যায়ে—প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে। সেখানেই শিক্ষার ভিত্তি নির্মিত হয়। তাই এই স্তরের শিক্ষকদের বেতন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি অপরিহার্য। যদি ভালো শিক্ষিত, মেধাবী মানুষকে প্রাথমিক স্তরে আনতে হয়, তবে বেতনকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধায় তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ভালো মানের শিক্ষক থাকলে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই শেখার প্রতি আগ্রহী হবে, তৈরি হবে ভবিষ্যতের মেধাবী প্রজন্ম।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
আমরা প্রায়ই বলি, বিশ্ববিদ্যালয় একজন মানুষকে পূর্ণতা দেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় আসলে শেষের ধাপ; যদি শুরুটা সঠিকভাবে গড়ে না ওঠে, তবে শেষের ধাপে মানুষ কখনো পূর্ণ মানুষে পরিণত হয় না। দেশপ্রেমের বীজ বুনতে হয় শৈশবে, মানবিকতার পাঠ দিতে হয় প্রাথমিক স্তরেই। ইংরেজি উচ্চারণ, গণিত বা বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ—সবকিছুই তৈরি হয় ছোটবেলার শিক্ষকের হাত ধরে। একজন ভালো শিক্ষকই পারেন শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা জাগাতে, ভয় দূর করতে এবং শেখাকে আনন্দে রূপ দিতে।
এই দিনে আমি গভীরভাবে স্মরণ করছি আমার বাবাকে। তিনি শুধু আমার বাবা নন, আমার প্রথম শিক্ষকও। আমার শিক্ষার হাতেখড়ি তাঁর কাছ থেকেই। শুধু আমি নই, আমার গ্রামের অধিকাংশ মানুষের জীবনে শিক্ষার আলো জ্বেলেছিলেন তিনি। ইংরেজি ও গণিতে তাঁর দখল ছিল অসাধারণ। ষাটের দশকে ডিগ্রি পাস করা একজন মানুষ সহজেই ভালো চাকরি পেতে পারতেন, কিন্তু তিনি শিক্ষকতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। তখনকার প্রজন্মের অনেকেই এই মহান পেশায় এসেছিলেন একধরনের মমতা, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের টান থেকে।
আজকের বাংলাদেশে সেই চিত্র অনেক বদলে গেছে। এখন শিক্ষকতায় মেধাবীদের ফিরিয়ে আনতে হলে রাষ্ট্রকে এই পেশাকে আবার আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে—সম্মান, সুযোগ ও প্রাপ্যের ভারসাম্য নিশ্চিত করতে হবে।
আগামী প্রজন্মের বাংলাদেশ গড়ে উঠুক নতুন সম্ভাবনায়, যার নেতৃত্বে থাকবেন শিক্ষক। সামাজিক মূল্যায়নে শিক্ষক থাকুন শীর্ষে। কারণ, শিক্ষক ও শিক্ষার উৎকর্ষই বদলে দিতে পারে বাংলাদেশ।
লেখক: অধ্যাপক মো. ফজলুল করিম, বিজিই বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল