মিউজিক্যাল লাভ
১.
পড়ন্ত বিকেল। নিহাদ লেকের পাশের বেঞ্চিতে বসে সূর্য ডুবা দেখছে আর গিটারে সুর তুলছে। প্রায়ই সে এখানে বসে থাকে, আর কল্পনার সংগীতজগৎ থেকে সুর বের করে গিটারে ফুটিয়ে তোলে। এ মুহূর্তে নিহাদ ওর লেখা স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা গানটার সুর তোলার চেষ্টা করছে, হঠাৎ ওর কাজে বিঘ্ন ঘটাল মেয়েলি কণ্ঠের কাশির খুক খুক শব্দ। এ সময়ে কেউ বিরক্ত করলে নিহাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, ভ্রু কুঁচকে মেয়েটির দিকে তাকাল।
-আসসালামু আয়ালইকুম।
ফিরে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে নিহাদের রাগ কর্পূরের মত উড়ে গেল। খোলা চুল, স্মিত হাসি, পড়ন্ত বিকেলের আলোর আভায় বেশ মায়াবী লাগছে। এক ধ্যানে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে সে।
-এই যে আসসালামুয়ালাইকুম।
-অলাইকুমআসসালাম। আপনি?
-আমি সুমাইয়া রাহা। প্রতিদিন বিকেলে ছোট ভাইকে নিয়ে এখানে ঘুরতে আসি, আপনাকে প্রায় দেখি এখানে বসে গিটার বাজান, ভালোই বাজাতে পারেন, আমার গিটারের টোন ভীষণ ভালো লাগে, ভাবলাম আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিই।
-আমি নিহাদ হোসাইন।
-আমি কি আপনাকে বিরক্ত করলাম? দেখে মনে হচ্ছে আপনি বিরক্ত।
- নো ইটস ওকে।
- আমি কি আপনার বন্ধু হতে পারি? যদি কোন আপত্তি না থাকে।
(নিহাদ কিছুক্ষণ ভাবল)
- ঠিক আছে, বন্ধু হতে পারেন।
-থ্যাংকস
রাহা একটা হাসি দিল। নিহাদ ভাবছে চশমা পরা মেয়েটিকে হাসলে মনে হয় চারপাশে মুক্তা ঝরে পড়ছে।
-সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আজ আসি আবার দেখা হবে।
রাহা চলে যাচ্ছে, নিহাদ ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, কে এই সুন্দরী মেয়ে? কথা নেই বার্তা নেই বন্ধু হয়ে গেল? আর আমিও বোকার মত হ্যাঁ বলে দিলাম।
কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে নিহাদ থেকে উঠে পড়ল, আজ আর সুর তোলা হবে না।
এভাবেই প্রথম পরিচয় হয় ওদের। রাহার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে একধরনের ভালোলাগা কাজ করে নিহাদের ভেতর। মেয়েটির চাঞ্চল্য, হাসি, কথা সবকিছু নিহাদকে মুগ্ধ করে, ধীরে ধীরে ওরা ভালো বন্ধু হয়ে যায়।
২.
রাহার গিটারের টোন খুব পছন্দ, একবার গিটার ছাড়া লেকে গিয়েছিল নিহাদ, আর তাই সে কি রাগ রাহার....
-আজ গিটার আননি কেন?
-আসলে ক্লাস থেকে সোজা এখানে চলে এসেছি, আনার সুযোগ পাইনি।
-কোন কথা শুনব না, যাও এখনি যাও গিটার নিয়ে এসো।
-মাত্র তো এলাম, এখনই যেতে হবে?
-হ্যাঁ এখনই, এটা তোমার গিটার না আনার শাস্তি, জান না তোমার গিটারের টোন না শুনলে আমার ভালো লাগে না।
রাহা অন্যদিকে মুখ ঘুরাল, নিহাদ বুঝল মেয়েটি অভিমান করেছে, সামান্য কারণেই অনেক অভিমান করে মেয়েটি। অবশেষে কান ধরে রাহার রাগ ভাঙায়। এভাবেই ওদের বন্ধুত্ব এগিয়ে যায়, ভালোলাগা থেকে কখন যে মনের মিল হয়ে যায় তা নিহাদ নিজেও বুঝতে পারে না। প্রতিদিন নিহাদ বাসা থেকে ভালোবাসি বলার প্র্যাকটিস করে আসে, রাহার সামনে গেলেই সব গুলিয়ে যায়।
৩.
এমনি করে রাহার জন্মদিন চলে আসে, নিহাদ সিদ্ধান্ত নেয় এবার রাহাকে তার মনের কথা জানাবে। বার্থডে গিফট নিয়ে নিহাদ বার্থডে পার্টিতে যায়। নীল শাড়ি পরে মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে রাহা নিহাদের কাছে আসে।
-এত লেট করলে কেন?
-কই লেট করলাম?
-তুমি পাঁচ মিনিট লেট।
-রাস্তায় জ্যাম ছিল, হ্যাপি বার্থডে রাহা।
নিহাদ নীল মলাটে মোড়ানো একটা ডায়েরি রাহার হাতে দেয়।
-তুমি তো লেখালেখি পছন্দ কর, মনের ভাবনা জগতের কথাগুলো এটাই লিখবে
-থ্যাংক ইউ। আজ আমার বার্থডে তাই তোমাকে ছেড়ে দিলাম।
-রাহা
-হুম বল
-না মানে একটা কথা..
-কি কথা বল...
-আসলে আমি...
(এই রাহা কেক কাটবি না? সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে। নীলিমা ডাক দেয়)
-আসছি এক মিনিট, কী বলবা বলো।
-Many Many Happy Returns Of the Day.
-Thanks A lot… এখন চলো কেক কাটি।
এভাবেই প্রতিবার নিহাদ শত চেষ্টার পরও রাহাকে তার মনের কথা বলতে পারে না। বার্থডে পার্টিতে সবাই মিলে নিহাদকে ধরে গান গাওয়ার জন্য। নিহাদ গিটার নিয়ে রেডি হয় গান করার জন্য।
-বন্ধুরা এই গানটি আমার একজন বিশেষ মানুষকে নিয়ে লেখা
[একবার তাকাও প্রিয়তমা আমার দুই চোখে
দেখ বড় ভালবাসি তোমাকে।
যখন তোমার দুই চোখে দেখি দুষ্টু হাসি,
বলতে ইচ্ছে করে কতটা ভালবাসি।
আমার ভালবাসার ছোঁয়ায় রাঙিয়ে দেব হৃদয় তোমার।
তুমি ভালবেসে হবে কি রাজকন্যা আমার?]
৪.
গান শেষ করার পর করতালিতে মুখরিত হয়ে উঠে চারদিক, সবাই নিহাদের কণ্ঠের প্রশংসা করে, নিহাদ রাহার দিকে তাকায়। রাহা তার মিষ্টি হাসিটা হাসতে থাকে। সেদিন রাতে নিহাদের গিফট করা ডায়েরিতে রাহা তার মনের কথাগুলো লিখে, লেখার সবটা জুড়েই ছিল নিহাদের কথা, ওদের বন্ধুত্বের কথা, নিহাদকে ভালো লাগার কথা। রাহাও নিহাদকে খুব পছন্দ করে, কিন্তু সে বলতে চায় না, সে চায় নিহাদ নিজের মুখে তাকে প্রপোজ করুক। এভাবেই চলতে থাকে তাদের সম্পর্ক, একজন আরেকজনকে অসম্ভব ভালবাসে কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারেনা। অবশেষে একদিন....
নিহাদ লেকে রাহার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ অনেকক্ষণ হয়ে গেল, নিহাদের টেনশন হচ্ছে, রাহার কিছু হলো না তো। অবশেষে রাহা এল।
-আজ এত দেরি করলে কেন?
-কোচিং ক্লাস ছিল, তাই আসতে লেট হল।
-এটা আগে বললেই পারতে।
-সরি সরি মনে ছিল না।
- ইটস ওকে। তোমার জন্য নতুন একটা সুর তুলেছি।
-আজ শুনতে পারব না, এমনিতেই অনেক লেট হয়ে গেছে, পরে বাসায় আম্মু টেনশন করবে।
-চলে যাবা? আর একটু বসো প্লিজ।
-নাহ, যেতে হবে। নয়তো প্রবলেম হবে।
-ঠিক আছে যাও।
-ভালো থেকো।
রাহা ঝটপট চলে যায়, শেষ বিকেলের সূর্যটাও ডুবতে শুরু করেছে, নিহাদ উঠতে যাবে, এমন সময় বেঞ্চির দিকে নজর পরে। রাহা ভুল করে ওর ডায়রিটা ফেলে গেছে। নিহাদ ডায়রিটা হাতে নিয়ে রুমের দিকে হাঁটা শুরু করে। নিহাদ রাতে ডায়রিতে ওকে নিয়ে লেখাগুলো পড়তে থাকে, বুঝতে পারে রাহাও তাকে ভালোবাসে।
৫.
পরদিন লেকে গিয়ে দেখে রাহা উদাসীভাবে বসে আছে।
-কখন এলে?
-অনেকক্ষণ।
-আজ দেরি করে আসার জন্য আমাকে বকা দিবে না?
(রাহা নিশ্চুপ)
-কি হয়েছে, মন খারাপ?
-কাল থেকে তোমার দেয়া ডায়রিটা খুঁজে পাচ্ছি না, কোথায় যে পড়ল!
-মন খারাপ করো না, ওরকম আরেকটা ডায়রি তোমার নেক্সট বার্থডেতে গিফট করব।
-স্টুপিড! ডায়রির জন্য না, লেখাগুলোর জন্য খারাপ লাগছে।
-ডায়রিতে কি লেখা ছিল জানতে পারি?
-না, এটা পারসোনাল। একি তুমি হাসছো কেন? আমার মন খারাপ আর তুমি হাসতেছো? থাকো তুমি আমি গেলাম।
(রাহা উঠে দাঁড়াল)
-রাহা শুনো
-কী?
-তোমার ডায়রিটা।
নিহাদ ডায়রিটা রাহার দিকে এগিয়ে দেয়। রাহা চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে, এটা তোমার কাছে এল কীভাবে?
-কাল ভুল করে এখানে ফেলে গিয়েছিলে।
-তুমি ডায়রির সব লেখা পড়েছো তাই না?
-কোনো সন্দেহ আছে?
নিহাদ, রাহার কাছে যায়, হাঁটু গেড়ে তার পাশে বসে...আর বলে
-ভালোবাসো?
-কোনো সন্দেহ আছে?
বলেই রাহা মুচকি হাসি দেয়।
এখন বেঞ্চিতে বসে রাহা নিহাদের কাঁধে মাথা রেখে নিহাদের গান শুনছে। নিহাদ গিটার বাজাচ্ছে আর গান করছে,
[তাঁরা ভরা জোছনার আলোতে,
তোমাকে খুঁজে পাই....
আমার মনের ভাবনার জগতে
তোমায় রাখতে চাই...
রঙধনুর আভায় ছড়িয়ে দাও
মনের ভাবনাগুলো.......
আজ ভালবেসে ছিনিয়ে নাও
অতৃপ্ত মনের ইচ্ছেগুলো.....]
শেষ বিকেলের সূর্যটা মনে হয় আজ ডুববে না, নিহাদের গান শেষ না হওয়া পর্যন্ত।
লেখক: নাহিদ হোসাইন, কবি ও কথাসাহিত্যিক, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ