জলবায়ু সম্মেলন: প্রত্যাশা ও অর্জন

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বনেতাদের ব্যর্থতা তুলে ধরতে প্রতিবাদ কর্মসূচির আয়োজন করেন অক্সফামের কর্মীরা। বৈশ্বিক উষ্ণতা ঠেকাতে বিশ্বনেতারা অকার্যকর লড়াই করছেন—তা প্রতীকীভাবে উপস্থাপনের জন্য নেতাদের মুখোশ পরে প্রতিবাদে যোগ দেন কর্মীরা
ফাইল ছবি

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ টুভ্যালু অন্যতম। সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইমন কোফে স্যুট, টাই পরিধান করে গত বছর সমুদ্রতীরের একটি লেকটার্নে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। মূলত গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক সম্মেলনে (কপ-২৬) জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে টুভ্যালুর ভবিষ্যৎ পরিণতির বিষয় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।

শুধু টুভ্যালু নয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে। গ্রীষ্মে গরমের তীব্রতা বেড়ে যাওয়া এবং শীতকালে অত্যধিক ঠান্ডা সে রকমই কিছু বার্তা দেয়। চলতি বছরে সিলেটে দুই দফা বন্যা এবং উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং জলবায়ুর পরিবর্তনের অশনিসংকেত দেখিয়ে দেয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে বন্যা, দাবানল, ঘূর্ণিঝড়, নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রভাব আমরা দেখেছি। আমরা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধির ভয়াবহতাও অনুভব করেছি।

Climate Trends–এর তথ্যমতে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ২০২২ সাল হলো সবচেয়ে সংকটময় বছর। এ বছরেই চীনকে ৭০ দিনের জন্য ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তাপমাত্রা মোকাবিলা করতে হয়েছে। ইউরোপে ৫০০ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে খরা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে দাবানল, খরা এবং বন্যার মতো দুর্যোগের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করতে হচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় ৮০ বছরের মধ্যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। বন্যায় পাকিস্তানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভারতকে ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সইতে হয়েছে। তবে, জলবায়ু বিপর্যয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। ঘূর্ণিঝড়, খরা, অনিয়মিত বৃষ্টি এমনকি হিমালয়ের জলচক্রের নিয়মিত পরিবর্তন হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে চলেছে। তা থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিবছরের মতো এবারও জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মিসরের শার্ম আল-শেখে ৬ নভেম্বর থেকে ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা কপ-২৭ সম্মেলন নামে পরিচিত।

কপ-২৭ সম্মেলনে যেসব বিষয় আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে, তার মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস, জলবায়ুর অভিযোজন এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু–সংক্রান্ত কাজে অর্থায়নে প্রতিশ্রুতি প্রদান। তবে বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর কথা পূর্বের সম্মেলনগুলোতেও বলা হয়েছিল। বিগত সম্মেলনের মাধ্যমে কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলো ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনতে বলা হয়েছিল। তবে তা বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ নেই। অন্যদিকে ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমাতে সম্মত হয়েছিল অনেক দেশ। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে বিশ্ব উষ্ণায়নের মাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জার্মানি ছাড়া বাকি দেশ তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তারও বহুবিধ কারণ রয়েছে। গরিব তথা উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি অনেকটা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে প্রচুর পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ হয়ে থাকে। তাই কার্বনের পরিমাণ কমাতে হলে জীবাশ্ম জ্বালানির পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলো ইচ্ছে করলেই জীবাশ্ম জ্বালানি কমাতে পারে না। সে জন্যই জলবায়ু পরিবর্তনে বিপর্যস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলো তহবিল গঠনের দাবি জানিয়ে আসছিল। যেখানে তহবিলের একটি অংশ নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানির জন্য বরাদ্দ থাকবে।

আইপিসিসির মতে, উষ্ণতার পরিস্থিতির পরিবর্তন না হলে চলতি দশকে শেষ নাগাদ কার্বন দূষণ ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। ফলে ভূপৃষ্টের উষ্ণতা ২ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। তবে প্যারিস চুক্তির অধীনে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন এক ডিগ্রির কয়েক দশমাংশ তাপমাত্রা হ্রাস পাবে।

আশার কথা, জলবায়ু–সংকট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র ‘ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট’ প্রণীত হয়েছে। এ আইনের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন প্রায় ৪০ শতাংশ কমতে পারে। বিদ্যুৎ, পরিবহন এবং শিল্প ক্ষেত্রেও পরিবেশবান্ধব জ্বালানি বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে ‘রি-পাওয়ার ইইউ’ নামে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে ইইউ’র। যার ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের ব্যবহার কমে আসবে। শীর্ষ ৫টি কয়লা উৎপাদক দেশের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া অন্যতম। ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৩ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক কয়লা পোড়ায় চীন। তবে ২০৩০ সালের পর চীন কার্বন নির্গমনের হার বাড়তে দেবে না বলে ব্যক্ত করেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কার্বন নির্গমনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। সে উদ্দেশ্যে দেশের মোট জ্বালানির অর্ধেক নবায়নযোগ্য উৎস থেকে জোগান দেওয়ার সামর্থ্যে থাকতে চায় ভারত।

প্যারিস চুক্তিতে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা প্রদানের কথা বলা হয়েছিল। সে অনুযায়ী ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের একটি তহবিলের নিশ্চিত করার কথা ছিল। যদিও সেটা পূরণ হয়নি। তবে কপ-২৬ সম্মেলনে সেই তহবিল নিশ্চিত করতে ২০২৩ সালের সময়সীমা দেওয়া হয়েছিল। দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, কপ-২৭ সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতির শিকার দেশগুলোর জন্য ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ নামে তহবিল গঠনে সম্মত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তহবিলের অর্থ দরিদ্র দেশগুলোর ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামোর ওপর জলবায়ুর ধ্বংস মোকাবিলা করা এবং উদ্ধারকাজ পরিচালনা ও পুনর্গঠনে ব্যয় করা হবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন প্রক্রিয়ায় খাপ খাওয়াতে সহায়তা করবে। যদিও বিগত সম্মেলনগুলোতে জলবায়ু বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হলেও ধনী দেশগুলো এর বিরোধিতা করে আসছিল। কাজেই ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড’ তহবিল গঠনে সম্মত হওয়া এ সম্মেলনের একটি বড় অর্জন বলা যেতে পারে।

লেখক: অনজন কুমার রায়, ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলামিস্ট