আমার বাবা এবং আমাদের মন্টু
২৬ বছর আগের কথা। আমাদের গ্রামের নাম, সুন্দলপুর, জেলা, নোয়াখালী। আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। ১৯৯৯ সাল।
আমাদের মন্টু তরতর করে বড় হচ্ছে। ওকে এতটা ভালোবেসে ফেলেছি যে চোখের আড়াল করতে পারছি না। স্কুল থেকে ফিরে কখন কিভাবে ওকে কোলে তুলে নেব ভাই বোনদের প্রতিযোগিতা শুরু হতো। তখন ও খুব ছোট। দু'টো চোখ কি মিষ্টি। দু'চোখে ঠিক উপরে সোনালী মায়াবী পশমের ছোপ। আর পুরো শরীরটা কুচকুচে কালো। এতক্ষণ যার কথা বলেছিলাম সে একটা কুকুর। যার নাম আমরা আদর করে মন্টু রেখেছিলাম। ও আমার বাবাকে খুব ভালবাসতো। আমার বাবা তখন ঘোষবাগ কাদেরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। বাবা যখন স্কুলে যেতেন, মন্টু বাবাকে মেইন রোড/পাকা সড়ক পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসত। আমাদের বাড়ি থেকে মেইন রোড একটু দূরে। বাবা সাইকেলে করে স্কুলে যাতায়াত করত। যেই দিন বাবার দেরি হয়ে যেত সেদিন বাবা মন্টুকে বলতো যা.. যা.. মন্টু বাড়ি যা, আমাকে তাড়াতাড়ি স্কুলে যেতে হবে। কিন্তু মন্টু যেতে চাইত না পরে ধমক দিয়ে বললে আর এগোতো না। কিন্তু দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকত যতক্ষণ বাবাকে দেখা যায়। বাবাও পেছনে ফিরে ফিরে দেখতো মন্টু গেল কিনা বাড়িতে। পরে বাড়ি ফিরে আমাদের মন্টুর কথাগুলো বলতো ভাত খেতে খেতে। তখন মন্টু আমাদের রান্না ঘরের দাওয়ার উপরে মুখটা তুলে রেখে দরজার সামনে শুয়ে থাকতো।
আমরা ছয় ভাই বোন। তখন বড়দা পড়াশোনার জন্য ফেনী পলিটেকনিকেল ইনস্টিটিউট আর মেজদা ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে। পরিবারের বাকি সদস্যদের খাবারের উৎচ্ছিষ্টাংশ মন্টুকে খাওয়ানো হতো। কিন্তু বাবা নিজের খাবার থেকে সুন্দর করে মেখে একমুঠো মন্টুর জন্য রেখে দিত, যতবার খাওয়া হতো ঠিক ততবার। মন্টুর খাবারের পাত্রও ছিল ঠিক করা।
একদিন বাবা ঘরের পাশে প্রায় ৫০ গজ দূরে ঝোপঝাড় পূর্ণ মাঝারি মানের বাগান পরিষ্কার করছিলো। সেখানে শীতলপাটি বানানোর গাছে পরিপূর্ণ ছিল। পরিষ্কার করার সময় বাবা একটা সাপ পালিয়ে যেতে দেখল কিন্তু আমাদের আর কিছু বলল না।
রাত প্রায় দুইটা, মন্টুর ঘেউ ঘেউ চিৎকারে বাবার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম থেকে উঠে বাবা দেখতে গেল বাহিরে কি হচ্ছে? কেনই বা মন্টু এত চিৎকার করছে ? বাবা দরজা খুলে বের হয়ে যা দেখল তাতে চোখ ছানাবড়া!
সকালে যে সাপটা পালিয়ে যেতে দেখেছিল ঠিক সেই সাপটাই আমাদের ঘরে ঢুকতে চেষ্টা করছে আর মন্টু পা দিয়ে সাপটাকে টেনে বের করার চেষ্টা করছে।
মন্টুর মনিবের প্রতি ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ দেখে আমাদের কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল।
আর একদিন ঘটল মজার ঘটনা। আমাদের দুধেল গাই ছিল। বিশেষ করে বৈশাখ মাসে নতুন ধানের খড় সারা বছরের জন্য সংগ্রহ করে বিশাল আকৃতির খড়ের গাদা বানিয়ে রাখতেন বাবা। তাই এক শুক্রবার ছুটির দিনে খড়ের গাদা তৈরির দিন ঠিক হলো। আটজন বদলা ঠিক করা হলো। ঐদিন সকাল থেকে কালবৈশাখী ঝড় আসবে আসবে করছে। এরই মধ্যে বদলারা চলে এল। বদলাদের দলনেতার নাম মন্টু। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। চারিদিকে হাঁক ডাক পড়ে গেল। বাবা মন্টু বলে লোকটাকে ডাকছে উনিও জবাব দিচ্ছে, এদিকে আমাদের মন্টু ও ঘেউ ঘেউ করে জানান দিচ্ছে কি জন্য ডাকছে? টেনশনের মধ্যেও সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে গেল!!
আমাদের মন্টুর জন্য কোন অপরিচিত লোক (চোর, ডাকাত) বাড়িতে ঢুকতে পারত না।আমার দাদু, কাকারা চিকিৎসক হওয়াতে অপরিচিত লোকজনের আসা যাওয়া বেশি ছিল।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় কিছুদিন পর মন্টুকে কারা যেন পিটিয়ে মেরে ফেলে। সেদিন আমরা খুব কেঁদেছিলাম । আর সৃষ্টিকর্তার কাছে ঐ অমানুষগুলোর বিচার চাইলাম।
*লেখক: সুজলা রানী মজুমদার, প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান, ফুলগাজী মহিলা কলেজ, ফুলগাজী, ফেনী।