বিশ্বে মাতৃভাষা আন্দোলন

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারফাইল ছবি

শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর কান্নার মাধ্যমে নবজাতক প্রথম চিৎকার করে মাকে জানিয়ে দেয়, ‘আমি ঠিক আছি’, এটিই নবজাতকের ভাষা।

বর্তমান বিশ্বে গণনাকৃত মোট ভাষার সংখ্যা ৬ হাজার ৯১২টি। ‘সিল’ নামের ভাষা গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিলুপ্তপ্রায় ভাষার সংখ্যা ৫১৬। জাতিরাষ্ট্রের এ রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ প্রবণতার বিপদ হলো বিশ্বে প্রায় ৭ হাজার ভাষার মধ্যে সর্বসাকল্যে মাত্র ৩০০ ভাষা (প্রায় ২৫০টি জাতিরাষ্ট্রের বিপরীতে) রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পায়, বাকি ভাষাগুলো থাকে অবহেলিত। এ অবহেলিত ভাষা কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে চরম অবহেলা আর অনাদরে। আবার অনেক সময় এই ভাষাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার নীলনকশা তৈরি করা হয়। প্রতিবাদমুখর মানুষ মায়ের ভাষা রক্ষা করতে গিয়ে জীবন বাজি রাখতে কার্পণ্য করেনি, তাই বিশ্বের ইতিহাসে তাই ভাষা আন্দোলন নামের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন–সংগ্রাম হয়েছে, মায়ের ভাষার মর্যাদার দাবিতে প্রাণ দিয়েছে মানুষ।

ভারতবিভক্তির পর পূর্ব পাকিস্তানে (বাংলাদেশে) ১৯৪৭-৫৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রতিটি বিষয় আজ সারা বিশ্ব জানে। বিশেষ করে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের সরাসরি সক্রিয় আন্দোলনে বাঙালির আত্মত্যাগ বিশ্ববাসী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করে। বাংলাদেশের বাইরে বিশ্বের অনেক স্থানে মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে। এ সম্পর্কে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের কথা। অন্ধ্র প্রদেশে তেলেগু ভাষাভিত্তিক প্রদেশের দাবিতে ১৯৫২ সালে গান্ধীবাদী শ্রীরামুলু নামের একজন সংগ্রামী অনশন করে মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর বিরাট প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে নেহেরু সরকার সেই দাবি মেনে নেন এবং তেলেগুভাষীদের নিজস্ব রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্ধ্র প্রদেশে শ্রীরামুলু ‘আজ অমরজীবী’ বলে সম্মানিত হন।

১৯৬০ সালের ৩ মার্চ আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা বিধানসভায় অসমিয়াকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা ঘোষণা করা হবে বলে জানালে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে এবং বাংলাকে সরকারি ভাষা করার জোর দাবি উত্থাপন করে। ১৯৬০ সালের ২১ ও ২২ এপ্রিল কংগ্রেস কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সভায় সাকল্যে ৩১ শতাংশ মানুষের ভাষা অসমিয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র রাজ্যভাষারূপে স্বীকৃতিদানের লক্ষ্যে একটি প্রস্তাব ৫০: ১০ ভোটে পাস হয়ে যায় এবং অচিরেই প্রস্তাবটি কার্যকর করার জন্য কংগ্রেসি মন্ত্রিসভাকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ২ জুলাই শিলচরে ডাকা হয় ‘নিখিল আসাম বাংলা ও অন্যান্য অনসমিয়া ভাষা সম্মেলন’। প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন লুসাই-খাসিয়া-গারো, মণিপুরি, বাঙালি সবাই। সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হয়, ‘ভাষার প্রশ্নে স্থিতাবস্থা বজায় থাকবে।’ ভাষার প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করতে কেন্দ্রের কাছে আবেদন জানানো হয়। ১০ অক্টোবর রাজ্যভাষা বিল পাস হয় বিধানসভায়। নতুন আইনে পুরো আসামে সরকারি ভাষা হলো অসমিয়া। পুরো কাছাড় প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠল, ‘এ রাজ্যভাষা বিল আমরা মানি না, মানব না। বাংলাকে সরকারি ভাষা করতে হবে।’

১৯৬১ সালের ১৫ জানুয়ারি শীলভদ্র যাজীকে সভাপতি করে করিমগঞ্জে সম্মেলন ডাকা হলো। শিলচর সম্মেলনে ভাষার প্রশ্নে পুরো কাছাড় এক মন এক প্রাণ হয়ে শপথ নিল, ‘জান দেব, তবু জবান দেব না। মাতৃভাষার মর্যাদা যেকোনো মূল্যে রক্ষা করবই।’ ৫ ফেব্রুয়ারি করিমগঞ্জ রমণীমোহন ইনস্টিটিউটে কাছাড় জেলা সম্মেলনে বাংলাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা রূপে মানার সিদ্ধান্ত হয়। সেই সঙ্গে আসাম সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়ে ১৩ এপ্রিলের মধ্যে শেষ জবাব চাওয়া হয়। ১৩ এপ্রিলের মেয়াদ শেষ হলেও কোনো জবাব না পেয়ে অসহযোগ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নতুন তারিখ ঘোষণা করা হয় ১৯ মে।

সংগ্রাম পরিষদের পূর্বসিদ্ধান্ত মতো ১৯৬১ সালের ১৮ মে রাত ১২টার পর থেকে তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের প্রায় ১০ হাজার মানুষ শিলচর রেলস্টেশনে অহিংস অবস্থান ধর্মঘট করার জন্য সমবেত হতে থাকে।

১৯ মে ভোর ৪টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত হরতাল ডাকা হয় বরাক উপত্যকায়। সকাল থেকে দলে দলে লোক জড়ো হয় তারাপুর রেলস্টেশনে। সবাই রেললাইনের ওপর বসে পড়ে সমস্বরে ধ্বনি তুলল, ‘জান দেব, জবান দেব না। মাতৃভাষা জিন্দাবাদ।’

শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। উত্তেজিত জনতাকে প্রতিরোধে সরকারি বাহিনী ট্রেন চালাতে ব্যর্থ হয়। ১৯ মে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পুলিশ তাঁদের অনেককেই গাড়িতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পুলিশ কয়েক দফায় লাঠিপেটা করে, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে এবং তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন অনেক রেল কর্মচারীরা। বেলা আড়াইটার দিকে রেলস্টেশনে কর্তব্যরত বিএসএফের সদস্যরা হঠাৎ গেরিলার ভঙ্গিতে গুলিবর্ষণ শুরু করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ শহীদ হন নয়জন। তাঁরা হলেন সুনীল সরকার, সুকোমল পরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, শচীন্দ্র পাল, কমলা ভট্টাচার্য, কানাই নিয়োগী। পরদিন স্টেশনের পুকুর থেকে সত্যেন্দ্রকুমার দেবের বুলেটে বিক্ষত দেহ উদ্ধার করা হয়। রাতে হাসপাতালে মারা যান বীরেন্দ্র সূত্রধর। মোট ভাষা শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১। ১৯ মে পুরো দিনটি ছিল উত্তাল ও ঘটনাবহুল। প্রশাসন কারফিউ জারি করে। গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় সাড়ে ছয় হাজার মানুষকে। কিন্তু তাতেও ক্ষান্ত হননি আন্দোলনকারীরা। তাঁদের রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অবশেষে ওই অঞ্চলের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রশাসনিক স্বীকৃতি দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়। ১১ জন ভাষাশহীদের রক্তের বিনিময়ে অবশেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী প্রদত্ত সূত্রের ওপর ভিত্তি করে গৃহীত সংশোধনী আইনে কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষা ব্যবহারের অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়। এভাবেই আসাম রাজ্যে ভাষা আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে এবং বাংলা ভাষা বিধানসভায় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

এরপরও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট বাচ্চু চক্রবর্তী নামের একজন মৃত্যুবরণ করেন। ৬ অক্টোবর মারা যান মোজাম্মেল হক। ৭ অক্টোবর রহস্যজনকভাবে নিরুদ্দিষ্ট হন অনিল বরা। ১৯৮৫ সালের ২৪ জুন কৃষ্ণ কান্ত বিশ্বাস ১৯ মের গুলির ক্ষতজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৬ সালে ২১ জুন দুজন মারা যান, তাঁদের নাম দিব্যেন্দ দাস, জগন্ময় দেব। তাঁদের এই আত্মত্যাগ বিশ্বে তেমন প্রচার পায়নি, এমনকি পশ্চিম বাংলা বা বাংলাদেশের মানুষের কাছেও নয়, যা খুবই দুঃখজনক।

মাতৃভাষায় শিক্ষার দাবিতে ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন দক্ষিণ আফ্রিকার হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গ স্কুলশিক্ষার্থী নেমে এসেছিল জোহানেসবার্গের কাছে সয়েটো শহরের রাস্তায়। পুলিশের গুলিতে সেদিনই ঝরে পড়ে ২৩টি কচি প্রাণ। আহত হয় দুই শতাধিক। পরদিনও বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে আফ্রিকানসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, সমাবেশ আর পুলিশের নির্বিচার গুলি। সয়েটো ছাড়িয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে উইটয়ারসল্যান্ড, প্রিটোরিয়া, ডারবান ও কেপটাউনে। বছরের শেষ নাগাদ নিহতের সংখ্যা পৌঁছাল ৫৫৭–এ। আহত হয় তিন হাজারের বেশি। আত্মোৎসর্গের বিনিময়ে শিক্ষার্থীরা পায় নিজেদের পছন্দমতো ভাষায় শিক্ষা গ্রহণের অধিকার। সয়েটোতে গড়ে ওঠে আরও স্কুল ও একটি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ। শিক্ষকেরা সুযোগ পান কর্মকালীন প্রশিক্ষণ আর যোগ্যতা অর্জনের জন্য শিক্ষা ভাতার। শহরে বসবাসকারী কালোরা পান স্থায়ী বাসিন্দার মর্যাদা। শহরে কালোদের ব্যবসা করার ওপর নিষেধাজ্ঞার আইনটিও বাতিল ঘোষিত হয়।

ভাষার অপমৃত্যু ঘটতে থাকলে কালের অতল গহ্বরে একদিন দু–একটি ভাষা ছাড়া হারিয়ে যাবে সব। তাই এখনই সময় আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষাসহ সব মাতৃভাষাকে রক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

পরিশেষে ভাষা আন্দোলন বলতে আমাদের যে একচ্ছত্র দাবি ছিল, আজ তা আর আমাদের একার নয়। এ দাবি ও অধিকার গোটা বিশ্বের মানুষের। মুহম্মদ জাফর ইকবাল যথার্থই বলেছেন, ‘...আগে আমরা ধরেই নিতাম একুশে ফেব্রুয়ারি মানেই বাংলা ভাষার জন্য ভালোবাসা, এখন আমরা আমাদের ভাবনাটাকে আরও একটু বড় করেছি। এখন বলছি এবং ভাবছি, একুশে ফেব্রুয়ারি মানে শুধু বাংলা ভাষা নয়, যার যার মাতৃভাষার জন্য ভালোবাসা।’

তথ্যসূত্র :
১. আতিউর রহমান (সম্পা.), ভাষা-আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক পটভূমি, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্কারণ ২০০০
২. জাহিদ আকতার, জাতিরাষ্ট্র ও মাতৃভাষার অধিকার, প্রথম আলো, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৮
৩. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, যে ভাষা ছড়িয়ে গেছে সবখানে, প্রথম আলো, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৮
৪.      ইসহাক কাজল ও মুজিব স্বদেশি (সম্পা.), বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাস, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ৩৮/৪ বাংলাবাজার, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৫
৫. এম আর মাহবুব, শিলচরে ভাষা আন্দোলন, প্রথম আলো, ১৯ মে ২০০৯
৬. আখতারুন নাহার আলো, ভাষার লড়াই: বরাকে বাংলা ভাষার শহীদ, দৈনিক সমকাল, ১৯ মে ২০০৯
৭.    মুহাম্মদ আসাদ, আসামে বাংলা ভাষা আন্দোলন, দৈনিক আমার দেশ, ১৯ মে ২০১০
৮. বদরুল হাসান, দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের ভাষা আন্দোলন, প্রথম আলো, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮
৯. এমাজউদ্দীন আহমেদ, মহান একুশের তাৎপর্য, প্রথম আলো, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৮
১০. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ভাষার জন্য ভালোবাসা, প্রথম আলো, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৮
*লেখক: আলী ছায়েদ, লেখক ও গবেষক এবং বিভাগীয় প্রধান, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি মহিলা কলেজ, দিনাজপুর