পরিবার: নিরাপত্তার আশ্রয় নাকি চাপের কেন্দ্র
পরিবার—সমাজের একটি মৌলিক ইউনিট হিসেবে আমাদের জীবনের কেন্দ্রে রয়েছে। এটি সেই প্রতিষ্ঠান, যেখানে একজন ব্যক্তি তার শৈশব, কৈশোর এবং জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত কাটায়। সামাজিক জীবনের সবচেয়ে কাছের সঙ্গী এই পরিবার, যা কি না কেবল রক্তের সম্পর্কের একটি কাঠামো নয়, এর মধ্যে নিহিত থাকে স্নেহ, আবেগ, সহানুভূতি, সান্ত্বনা এবং শুশ্রূষা; যা আমাদের মানসিক প্রশান্তি ও সমর্থনের প্রধান উৎস। কিন্তু বর্তমান সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় যখন এ আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে চাপের কেন্দ্র, তখন পরিবার শব্দটির অর্থ কিংবা ধারণা বদলে যায়।
পরিবার হওয়া উচিত একজন ব্যক্তির জন্য সেই স্থান, যেখানে সে কোনো বিপদে পড়লে নিঃশর্ত সমর্থন পায়, যেখানে কোনো ভুলের জন্য তাকে বিচার না করে বরং তাকে সাহায্য করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা কী তা–ই? অধিকাংশ সময়, পরিবারের মধ্যে সেই সহানুভূতি এবং সমর্থনটির অভাব লক্ষ করা যায়, যেখানে একজন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি একাকিত্বে ভুগতে থাকে।
অনেকের কাছে পরিবার আজকাল হয়ে দাঁড়িয়েছে এক চাপের কেন্দ্র, যেখানে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, স্বপ্ন এবং চাহিদা প্রায়শই চাপিয়ে দেওয়া হয়। প্রশ্ন উঠছে, পরিবার এখন কি সত্যিই নিরাপত্তার আশ্রয়, নাকি তা চাপের বোঝা?
মানুষের জীবনে পরিবার মাত্রই পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। এটি শুধু শারীরিক এবং মানসিক নিরাপত্তা দেওয়ার বেলাতেই সীমাবদ্ধ নয় পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও মানসিক কাঠামোও। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, কি পরিমাণে পরিবার আমাদের নিরাপত্তার আশ্রয়!
পরিবারের ভূমিকা: ভালোবাসা না বিচার?
পরিবারের প্রাথমিক ভূমিকা হচ্ছে সদস্যদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি করা, যেখানে তারা তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে বিনা দ্বিধায় কথা বলতে পারে। তবে বেশির ভাগ সময় পরিবার এই ভূমিকা পালন করার পরিবর্তে নিজস্ব সম্মান, সমাজের ভয় এবং ব্যক্তিগত ইগো নিয়ে ভাবতে শুরু করে। সন্তানের জীবনে কোনো সমস্যার সৃষ্টি হলে, তাকে যে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দেওয়া উচিত, সেই পরিবার অনেক সময় তাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
এটি কেবল সন্তানের মানসিক অবস্থা আর আত্মবিশ্বাসকেই ভেঙে দেয় না, বরং তাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। যে পরিবারটি সন্তানের পাশে দাঁড়াতে পারবে না, সে পরিবারই সমাজে একটি বৃহত্তর সমস্যার সৃষ্টি করবে। পরিবার যদি এমন বার্তা দিতে পারে, ‘তুমি যা-ই করো না কেন, আমরা তোমার পাশে আছি,’ তাহলে অনেক তরুণ-তরুণীর জীবনে পরিবর্তন অনেকাংশে সহজ হয়ে যেতে পারে, এমনকি এড়ানো যেতে পারে বহু অপ্রত্যাশিত বিপদ।
আজকের সমাজে পরিবারের ওপর চাপের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। শাশ্বত মূল্যবোধের জায়গায় পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে লুকিয়ে আছে কিছু গুরুতর সমস্যা। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ব্যক্তিগত বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এসব সমস্যা উত্থিত হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবারে সদস্যদের মধ্যে নিজেদের প্রত্যাশা, চাহিদা, সম্পর্কের জটিলতা এবং দায়িত্বের ভার বেড়ে চলেছে। এই চাপ শুধু তরুণদের নয়, মধ্যবয়সী কিংবা বৃদ্ধদের মাঝেও অবসাদ, মানসিক চাপ এবং হতাশা বাসা বাধছে। এমনকি শিশুরাও তাদের মা–বাবার কাছ থেকে যে নিরাপত্তা প্রত্যাশা করে, তা এখন অনেক ক্ষেত্রেই পূরণ হয় না।
সমস্যার মূল কারণ
এটি একটি দুঃখজনক বাস্তবতা যে আমাদের পরিবারগুলো সহানুভূতির পরিবর্তে সমালোচনার স্থান হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণেই সমস্যার মূল কারণগুলো আমাদের জানা প্রয়োজন:
১.
সহানুভূতির অভাব: পরিবারে অনেক সময় সহানুভূতির পরিবর্তে কঠোর সমালোচনা বেশি দেখা যায়, যা একজন ব্যক্তির মানসিক শান্তিকে আঘাত করে।
২.
সমাজের ভয়: ‘লোকেরা কী বলবে’—এই চিন্তা পরিবারগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
৩.
মিথ্যা ইগো: সামাজিক সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মিথ্যা ইগো সৃষ্টি হয়, যা তাদের আন্তরিক সহানুভূতির পথে বাধা সৃষ্টি করে।
৪.
স্বাস্থ্যগত সমস্যায় অবহেলা: পরিবারের কোনো সদস্যের শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা পুরো পরিবারে মানসিক ও আর্থিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
৫.
অর্থনৈতিক সংকট: জীবনযাত্রার ব্যয় দিন দিন বেড়ে চলেছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য আর্থিক অস্থিরতা সংসারে একধরনের হতাশা এবং অবক্ষয় দেখা দেয়, যা পরিবারের অন্য সদস্যদের ওপরও প্রভাব ফেলে।
৬.
সম্পর্কের জটিলতা: পরিবারের ভেতরে মতপার্থক্য, ভুল–বোঝাবুঝি এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব পরিবারের শান্তি নষ্ট করার অন্যতম কারণ। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতবিরোধ, মা–বাবা ও সন্তানের মধ্যে প্রজন্মের ব্যবধানের কারণে পরিবারের সদস্যরা একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যায় এবং মানসিকভাবে একাকিত্বে ভোগে।
৭.
সামাজিক প্রত্যাশা ও প্রতিযোগিতা: সন্তানদের উচ্চশিক্ষা, চাকরি বা সামাজিক মর্যাদা অর্জনের প্রতিযোগিতা পরিবারে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। সন্তানদের ভালো ফলাফল করতে হবে, চাকরিতে উন্নতি করতে হবে, এবং পরিবারের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখতে হবে—এমন চাপ প্রতিনিয়ত একজন ব্যক্তির মানসিক শান্তি কেড়ে নেয়। যখন সবাই শুধু নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকে, তখন পারস্পরিক যোগাযোগ ও সম্পর্কের খোলামেলা দিকগুলো সংকুচিত হতে থাকে।
৮.
কর্মজীবন ও পারিবারিক জীবনের ভারসাম্যহীনতা: পেশাগত জীবন ও পারিবারিক জীবন মেলানো কখনো কখনো সম্ভব হয় না, যার কারণে মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
উচ্চাকাঙ্ক্ষার পেছনে ছুটতে গিয়ে কর্মজীবন এবং পারিবারিক জীবনের ভারসাম্য নষ্ট হয়।
৯.
বাহ্যিক প্রভাব ও প্রযুক্তির অপব্যবহার: প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে পরিবারে ব্যক্তিগত সময় ব্যাহত হয়। পাশাপাশি সামাজিক মাধ্যমে ভুয়া সুখের চিত্র দেখে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়।
১০.
সমাজের প্রত্যাশা ও পারিবারিক ইমেজ: সমাজের চোখে পরিবারকে ‘আদর্শ’ হিসেবে উপস্থাপনের চাপ অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্যদের প্রকৃত অনুভূতি ও ব্যক্তিগত চাহিদাকে দমন করতে বাধ্য করে। একজন নারীকে ‘সুখী গৃহিণী’ হতে হবে, একজন পুরুষকে ‘পারিবারিক নায়ক’ হতে হবে, আর সন্তানেরা হতে হবে ‘অর্জনের প্রতীক’। এই চাপগুলো পরিবারে কৃত্রিমতা ও অস্বস্তি সৃষ্টি করে।
সমাধান কোথায়?
পরিবারে মৌলিক পরিবর্তন আনা বেশ জরুরি। পরিবারের সদস্যদের উচিত তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা এবং তাদের ভূমিকা পুনর্বিবেচনা করা। সহানুভূতি, সমর্থন এবং নিরাপত্তা একটি পরিবারকে তার সদস্যদের জন্য শক্তিশালী আশ্রয়স্থলে পরিণত করতে পারে।
১. মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষার প্রচলন: পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা অপরিহার্য। তাদের বুঝতে হবে যে, সহানুভূতি এবং সমর্থন একজন ব্যক্তির জীবন এবং মানসিক শান্তি বজায় রাখার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
২. নিঃশর্ত সমর্থন: যখন পরিবারের কোন সদস্য সমস্যায় পড়ে, তখন তাকে শুধু ভুলের জন্য বিচারের মুখোমুখি না করে, তার পাশে দাঁড়ানো এবং সাহায্য করার চেষ্টা করা উচিত।
৩. সচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল, কলেজ এবং কমিউনিটি পর্যায়ে পরিবার এবং সমাজের ভূমিকা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে, যেন এক একটি পরিবার তার সদস্যদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
৪. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা: পরিবারে আয়-ব্যয়ের মধ্যে সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকা জরুরি। এক্ষেত্রে সদস্যদের সবার মতামত অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাজেট তৈরি এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমানো উচিত।
৫. খোলামেলা আলোচনা: পরিবারের সদস্যদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা এবং মতামত বিনিময়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
৬. পরিকল্পিত সময় বিনিয়োগ: পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো এবং মানসিক বন্ধন দৃঢ় করা অত্যন্ত জরুরি।
৭. সামাজিক চাপ এড়ানো: অন্যের সঙ্গে তুলনা না করে নিজের পরিস্থিতি অনুযায়ী সন্তুষ্ট থাকার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
৮. বিবেচনা: প্রত্যেক সদস্যের চাহিদা ও সীমাবদ্ধতাকে সম্মান করতে হবে।
৯. সমাজের চাপ এড়ানো: সামাজিক প্রত্যাশার পরিবর্তে পরিবারের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক ও সুখকে গুরুত্ব দিতে হবে
১০. প্রত্যাশার ভার কমানো: প্রত্যেকের সামর্থ্য এবং সীমাবদ্ধতাকে সম্মান করে প্রত্যাশার ভার কমাতে হবে।
পরিবার: সমস্যার সমাধান হতে পারে পরিবার একটি ছোট আকারের সমাজের প্রতিরূপ। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মানুষের জীবনের প্রাথমিক ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হলো পরিবার। ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজ—এ ত্রিভুজের ভারসাম্যহীনতার কারণে পরিবার এখন চাপের একটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। তবে, পরিবর্তনের মাধ্যমে চাপের উৎসগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং সহযোগিতা পরিবারকে চাপমুক্ত রাখতে পারে।
কাজেই, আমরা যদি একে অপরের দুঃখ,ব্যথা এবং সমস্যাগুলো সঙ্গী হিসেবে দেখতে শিখি তাহলেই পরিবার তার বাস্তব চেহারা খুঁজে পাবে। আর পরিবারে সুখের জায়গা তৈরি করতে পারলেই ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে ভারসাম্য ফিরে আসবে। কারণ, একটি সুখী পরিবারই একটি সুন্দর সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি।
পরিবারে সুরক্ষা, ভালোবাসা, আশ্রয় এবং সমর্থনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হলে আত্মহত্যা, মানসিক অবসাদ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতাসহ বহু সমস্যা কমে আসবে। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণের মাধ্যমে আমরা পরিবারকে একটি নিরাপদ, সুখী এবং মানসিক শান্তির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারি।
* লেখা: শিউলী আকতার জেমি