বৃষ্টি, চা আর আমি!

বৃষ্টির আকাশ যখন মেঘে ঢেকে যায়, পৃথিবী যেন নিজেকে একধরনের শীতল শান্তিতে মুড়ে ফেলে। হালকা বৃষ্টির শব্দে বাতাস যেন সংগীত হয়ে ওঠে, আর মাটিতে পড়া প্রতিটি ফোঁটা একটি নতুন গল্পের জন্ম দেয়। এমন এক সকালে, যখন বৃষ্টির নরম ফোঁটায় পৃথিবী স্নান নিচ্ছে, চায়ের কাপ হাতে দাঁড়ানো যেন একটি নিভৃত মুহূর্তের অবিস্মরণীয় সাক্ষী হওয়া।

বৃষ্টি পড়ছে একটানা, কিন্তু ঝড় নয়—একটা নীরব, কোমল বৃষ্টি। মেঘলা আকাশের নিচে সবকিছু যেন নিজের রং বদলে ফেলেছে। গাছপালার সবুজ রং আরও গাঢ় হয়েছে, আর মাটির গন্ধের সঙ্গে মিশে আছে বৃষ্টির সোঁদা সৌরভ। এমন সময়ে হাতে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা থাকলে জীবনের ছোট্ট ছোট্ট আনন্দগুলো যেন বড় হয়ে ধরা দেয়।

আমি একলা ছুটে গেলাম, এক কাপ চায়ের টানে! সামনে একটি জনশূন্য দোকানে গিয়ে চা চাইলাম। টেবিলের ওপর এক কাপ চা! বৃষ্টিভেজা বাতাস আমার গায়ে এসে পড়ছে, আর সেই সঙ্গে চায়ের উষ্ণতা যেন মনের ভেতর ছড়িয়ে পড়ছে। চায়ের কাপ থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়া বৃষ্টির সঙ্গে যেন এক অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ধোঁয়া উড়ছে বাতাসে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটায়। এই মেলবন্ধন দেখেই হয়তো কবিরা তাঁদের কাব্যের ভাষা খুঁজে পান।

চায়ে প্রথম চুমুক দিয়ে আমি চোখ বন্ধ করলাম। এত দিন পর চা খাওয়া, সেই চেনা স্বাদটাকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করছি। যেন এই স্বাদে একধরনের স্মৃতি লুকিয়ে আছে—যা বৃষ্টিভেজা পরিবেশের সঙ্গে গভীরভাবে মিলে গেছে। চায়ের তিক্ততা ও মিষ্টতার মিশ্রণ ঠিক যেমন বৃষ্টির সঙ্গে পৃথিবীর মিষ্টি ও সোঁদা গন্ধের মিশ্রণ। মনে হচ্ছে, চায়ের প্রতিটি চুমুকের সঙ্গে আমি একটু একটু করে প্রকৃতির আরও কাছে চলে আসছি।

বৃষ্টির দিনগুলোতে সবকিছুতেই যেন একধরনের মায়া লেগে থাকে। বাতাসে একটা শীতলতার ছোঁয়া, চারপাশের নিস্তব্ধতা আর সেই সঙ্গে চায়ের উষ্ণতা। এমন মুহূর্তগুলোতে সময় থেমে থাকে বলে মনে হয়। বাইরের পৃথিবী যতই ব্যস্ত থাকুক, এই মুহূর্তে আমি ও আমার চারপাশের প্রকৃতি যেন এক হয়ে গেছে।

বৃষ্টির এমন হালকা ফোঁটায় পৃথিবীটা যেন একটু অন্য রকম হয়ে যায়। প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাতা, প্রতিটি ফুল যেন নতুন প্রাণ ফিরে পায়। বৃষ্টিভেজা রাস্তায় হাঁটতে ইচ্ছা করে, কিন্তু এই চায়ের কাপে আমি যেন আটকে আছি। কাপের গায়ে জমে থাকা পানির বিন্দুগুলো দেখতে দেখতে মনে হচ্ছে, এই ছোট ছোট বিন্দুর মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমার জীবনের কিছু পুরোনো গল্প। সেই গল্পগুলো বৃষ্টির ফোঁটায় ধুয়ে গিয়ে নতুন রূপ পাচ্ছে।

এই সময়ে চায়ের চুমুকে মনে পড়ে যায় বৃষ্টিতে কাটানো শৈশবের দিনগুলো। তখন তো ছাতা নিয়ে বৃষ্টিতে বের হওয়ার চেয়ে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হাঁটা ছিল বেশি মজার। এখন আর সেই দিন নেই, তবে চায়ের কাপ হাতে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকা যেন সেই দিনগুলোর একটা প্রতিফলন। মনে হয়, সময়টা একমুহূর্তের জন্য ফিরে এসেছে।

বৃষ্টির গন্ধটা যেন চায়ের সঙ্গে আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। প্রতিটি চুমুকের সঙ্গে বাতাসে ভেসে আসছে ভেজা মাটির গন্ধ, আর সেটা যেন মনকে শান্ত করছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, আমি আবার চায়ের কাপটা হাতে নিলাম। মনে হচ্ছে, এই বৃষ্টির দিনে চায়ের সঙ্গে আমার একটা গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে।

প্রকৃতি তার নিজস্ব ছন্দে কথা বলছে, আর আমি সেই ছন্দের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই, হালকা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এই মুহূর্তটা চিরকাল থাকুক, এই ধোঁয়া ওঠা চা আর বৃষ্টিভেজা বাতাসের সঙ্গে আমার নিঃসঙ্গতা যেন অমূল্য হয়ে উঠেছে।

চায়ের প্রতিটি চুমুক যেন আমাকে প্রকৃতির আরও গভীরে নিয়ে যাচ্ছে। জীবনের সমস্ত ব্যস্ততা, সমস্ত দুঃখ যেন এ মুহূর্তে গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে, চায়ের কাপ হাতে, আমি অনুভব করছি যে জীবন আসলে কত সুন্দর! বৃষ্টির দিনগুলো আমাদের জীবনের সেই মুহূর্তগুলোকে মনে করিয়ে দেয়, যা আমরা ব্যস্ততার মধ্যে ভুলে যাই। এই বৃষ্টি ও চা আমাকে সেই হারানো মুহূর্তগুলো খুঁজে পেতে সাহায্য করছে।

হয়তো বৃষ্টি এমনই। এটা শুধু মাটিকে ভেজায় না, আমাদের মনকেও ভিজিয়ে দেয়। আর চা সেই অনুভূতিকে আরও গভীর করে তোলে। আমি চায়ের কাপটা শেষ করে রেখে দিলাম, আর বৃষ্টি এখনো পড়ছে। কিন্তু মনের ভেতর একটা অদ্ভুত প্রশান্তি নেমে এসেছে। যেন এই ছোট্ট মুহূর্তটায় আমি প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে গেছি।

বৃষ্টি এবং চা—এই দুইয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক গভীর সংযোগ, যা হয়তো আমরা সচরাচর উপলব্ধি করতে পারি না। কিন্তু এমন এক দিনে, যখন বৃষ্টি আমাদের চারপাশকে ভিজিয়ে দেয়, চায়ের কাপে সেই সংযোগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

লেখা: রেশমা আক্তার রিয়া, জগদল কলেজ, পঞ্চগড়