সেই দুঃস্বপ্ন যেন ভর করেছিল, আবার কি…

জয়ের জন্য একটি রান নেওয়া যাচ্ছে না! আমার মনে পড়ে গেল, ভারতের বিপক্ষে শেষ তিন বলে ২ রান নিতে পারেনি বাংলাদেশ। আর তো তিনটি বলই আছে! রান লাগবে একটি। টেনশন!

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের পর গতকাল বাংলাদেশের অপরাজিত দুই ব্যাটসম্যান নাসুম আহমেদ ও শামীম হোসেনছবি: এএফপি

ছাত্রজীবন থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভক্ত আমি। সেই ’৯৭ সালে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন; মালয়েশিয়ার কিলাত কিলাব মাঠে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে কেনিয়াকে হারিয়ে আইসিসি ট্রফি জয়ের ধারাভাষ্য রেডিওতে শোনা; ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট ম্যাচ; সবই যেন চোখে ভাসে। এ এক অন্য রকম আবেগ।

পেশাগত জীবনের কঠিন সময়ে এসেও বাংলাদেশের যেকোনো জয়ে উল্লসিত হই। হারে ‘সবজান্তা ক্রিকেটভক্তদের’ মতো ম্যাচের পরিস্থিতিতে কোন খেলোয়াড়ের কী করা উচিত ছিল, সেই ‘বিশ্লেষণ’ করি। সঙ্গে সেই ‘কখনো শেষ না হওয়ার বিতর্ক’, টসে জিতে আগে ব্যাটিং করা উচিত ছিল নাকি বোলিং! যদিও জীবনের চরম বাস্তবতায় এখন টিভিতে নিয়মিত সব খেলা দেখা হয়ে ওঠে না; সেই ‘বিতর্ক’-‘বিশ্লেষণ’ও কমে গেছে অনেক।

গতকাল অফিসে কাজের ফাঁকে টিভিতে দেখছিলাম এশিয়া কাপের সুপার ফোরের ম্যাচটি। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে জয়ী হয়ে ভক্তদের ফাইনালে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন টাইগাররা। কিন্তু ম্যাচ জয়ের আগে শেষ ওভারে যা হলো, তাতে তো আমার মতো ভক্তদের ওপর  সেই দুঃস্বপ্ন ভর করছিল, আবার কি তীরে এসে তরি ডুববে! জয়ের বন্দরে ভিড়তে পারবে বাংলাদেশ! এর আগেও যে হাতে ছোঁয়ার মতো দূরত্ব থেকে জয়বঞ্চিত হওয়ার উদাহরণ আছে! সেগুলো যেন উঁকি দিচ্ছিল বারবার! যদিও গতকাল হার নয়, টাই হওয়ার আশঙ্কা জেগেছিল। এমন ম্যাচ টাই হওয়াই তো বাংলাদেশের পরাজয়!

ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচ

বাংলাদেশের কোনো ম্যাচে এমন পরিস্থিতি হলেই আমার প্রথম মনে পড়ে ২০১৬ সালের টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষের ম্যাচটির কথা। খ্যাতিমান ক্রীড়াসাংবাদিক উৎপল শুভ্র সেই ম্যাচ নিয়ে প্রথম আলোতে ‘তীরে এসে ডুবল তরি’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘এই ম্যাচ হৃদয় ভেঙে দেওয়া এক দুঃখের নাম। হাতের মুঠোয় নিয়েও জয়টাকে ছুড়ে ফেলার ম্যাচ। এমনই অবিশ্বাস্যভাবে যে, দুঃখ শব্দটা এখানে ‘শোক’ হয়ে যেতে চায়।’

শেষ ৩ বলের নাটকে প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাওয়া জয় উঠল হাতের মুঠোয়, উল্লসিত তাই ভারতীয় দল। তাদের উল্লাসের পাশে আড়াল হয়ে গেলেন বাংলাদেশের দুই ব্যাটসম্যান। ভারতের বেঙ্গালুরুতে l
ফাইল ছবি: এএফপি

ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচে শেষ ওভারে ১১ রান দরকার ছিল বাংলাদেশের। প্রথম তিন বলেই বাংলাদেশ তুলে নেয় ৯ রান। শেষ তিন বলে দরকার ২ রান। বোলার হার্দিক পান্ডিয়া, যার বলে পরপর দুটি চার মেরে ক্রিজে মুশফিকুর রহিম। পরের বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে তিনি ডিপ মিড উইকেটে ক্যাচ দিয়ে আউট। ততক্ষণে স্ট্রাইকে চলে গেছেন মাহমুদউল্লাহ। বাংলাদেশের দরকার ২ বলে ২ রান। পরের বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আউট মাহমুদউল্লাহও! আর শেষ বলে রান আউটে ম্যাচটা ‘টাই’ও হলো না। ৩ বলে ২ রান চাই, আর সেই তিন বলেই তিন উইকেট! বাংলাদেশের দুঃস্বপ্নের হার! যা এখনো মাঝে মাঝে তাড়া করে আমার মতো ভক্তদের। সেই ম্যাচের স্কোর (ভারত: ২০ ওভারে ১৪৬/৭; বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৪৫/৯)।

এশিয়া কাপের সেই ফাইনাল

এশিয়া কাপের সেই ফাইনালের কথাও তো মনে পড়ল! দেশের মাটিতে ২০১২ সালের এশিয়া কাপ। যেখানে ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। সেই ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ২ রানে হেরে যায় টাইগাররা। সেটা ছিল ৫০ ওভারের ম্যাচ।

সেই ম্যাচে শেষ ১০ ওভারে বাংলাদেশের ৮৪ রানের দরকার ছিল। শেষ ৫ ওভারে যা দাঁড়ায় ৪৭ রানে। এরপর ৪৭তম ওভারে বাংলাদেশ তোলে ১৪ রান। লক্ষ্যটা হাতে ছোঁয়ার দূরত্বে চলে আসে। শেষ ৩ ওভারে দরকার ২৫ রান। শেষ বলে দরকার ছিল চার রান,  উইকেটে তখন ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান শাহাদাত হোসেন। তিনি নিতে পারলেন এক রান। তাঁরই বা কী দোষ! ৪৬তম ওভারে দলকে ১৯০ রানে রেখে আউট মুশফিক। ৪৮তম ওভারে আউট মাশরাফি, দলের রান তখন ২১৮। এরপর শেষ বলের আগের বলে আউট রাজ্জাক। সেই ম্যাচের স্কোর (পাকিস্তান: ৫০ ওভারে ২৩৬/৯; বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৩৪/৮)।

এই ছবি কি আর ভোলার মতো! ২০১২ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালে হেরে সাকিবের কান্না
ছবি: শামসুল হক

এই ম্যাচ নিয়ে উৎপল শুভ্র ‘এত কাছে, তবু এত দূর!’ শিরোনামে লেখাটা শুরুই করেছেন, ‘অঝোরে কাঁদছেন মুশফিকুর রহিম। অধিনায়ককে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন সাকিব আল হাসান। ঠোঁটে অদ্ভুত একটা হাসির রেখা। চিকচিক করতে থাকা চোখ আর ওই হাসি মিলিয়ে এমন একটা বেদনার্ত ছবি, যা হৃদয়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়।’

এমন হার তো আমার মতো ভক্তদের কাছে ‘হৃদয় এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়ার’ মতোই! এমন হার তো আরও আছে! বলছি, ২০০৯ সালে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজের ফাইনালে শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে যাওয়া ম্যাচটির কথা। সেটাই–বা ভুলি কী করে! মিরপুরে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে স্পিন কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরনের ব্যাটিংয়ে হেরেছিল বাংলাদেশ। ইনিংসের শুরুতে ৬ রানের মধ্যে শ্রীলঙ্কার ৫ উইকেট ফেলে দেওয়ার পরও পারেনি টাইগাররা।

উদাহরণ তো আরও আছে! ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত নিদাহাস ট্রফির ফাইনালে ভারতের এক দীনেশ কার্তিকের কাছেই তো হেরে গেল বাংলাদেশ। ওই দিন ‘অতিমানব’ হয়ে ওঠা কার্তিক ৮ বলে ২৯ রান করে জিতিয়েছিলেন ভারতকে। শেষ বলে দরকার ছিল পাঁচ রান। ছয় মেরে বাংলাদেশের জয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।

গতকাল বাংলাদেশের জয়ের ম্যাচে শেষ ওভারে নাটকীয়তা। বাংলাদেশের স্কোর ততক্ষণে শ্রীলঙ্কার সমান হয়ে গেছে (১৬৮)। জয় থেকে ১ রানের দূরত্বে বাংলাদেশ। সেই সময় জাকের আলী কিনা বড় শট খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে গেলেন। এক বল পরে আউট মেহেদী হাসান! ৩ বলের মধ্যে বাংলাদেশ হারিয়ে বসে ২ উইকেট! জয়ের জন্য সেই একটি রান নেওয়া যাচ্ছে না! আমার মনে পড়ে গেল, ভারতের বিপক্ষে শেষ তিন বলে ২ রান নিতে পারেনি বাংলাদেশ। আর তো তিনটি বলই আছে! রান লাগবে একটি। টেনশন!

তবে নাসুম এসে টেনশন দূর করলেন। তিনি মুখোমুখি হওয়া প্রথম বলেই জয়সূচক রান নিয়ে মাতালেন দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। সেই সঙ্গে বন্ধ করতে সক্ষম হলেন আমার মতো ‘সবজান্তা ক্রিকেটভক্তদের’ দেশের ক্রিকেট নিয়ে অন্তত এক দিনের সমালোচনাও!