বাড়ি থেকে যখন ফিরি, আব্বা বরাবরই ট্রেনে উঠিয়ে দেন। কনকনে শীতের রাত। ঠান্ডায় শরীর বরফ হয়ে যায় যেন। এবার আব্বাকে না করলাম। ‘ট্রেনে তুলে দিতে হবে না! এমনি তোমার গলা ভেঙে গেছে। আর ঠান্ডা বাড়াইও না।’
কপালে হাত দিয়ে দেখি জ্বর অনেক। বললাম, ‘ওষুধ খেয়ো কিন্তু ঠিক করে।’
তিনি শান্ত গলায় প্রত্যুত্তর করলেন, ‘আচ্ছা, বাবা। ঠিক আছে রে। তুই সাবধানে যাইস। এমনি ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করিস না এত।’
আসার সময় ব্যাগ গুছিয়ে দেন মা। ব্রাশ, টুথপেস্ট, সাবান! গামছা। কাপড়। ওষুধের নতুন পাতা। সঙ্গে রান্না করা খাবার। ট্রেনে নাকি ক্ষুধা লাগবে, তখন এত রাতে কী খাব! তিনি জীবনটাকেই যেন ব্যাগের ভেতর গুছিয়ে দেন।
এবার আসার সময় বলল, ‘না গেলে হতো না! থাকতি, কয়েক দিন পরে যাইতি।’
বললাম, ‘মা, এমন অস্থির পরিবেশে আমারও যাইতে মন চাচ্ছে না। কিন্তু কী করা। ভাইভাটা তো দিতেই হবে। সামনে যদি রেজাল্ট হয়, তখন গোছাতে পারব না। আবার টিউশনটায় অনেক দিন গ্যাপ দিছি। ওখান থেকে “না” করে দিলে চলা কঠিন।’
‘সাবধানে যাইস। ট্রেনের জানালা খুলবি না। পাথর ছোড়ে। কত সমস্যা হয়। দোয়া পড়ে তারপর বসবি। বাড়ির কথা চিন্তা করিস না। ঠিক হয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা মা। দেরি হয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছি।’
‘“যাই” বলে না বাবা, বল যে “আসি”।’
মাথা নাড়ালাম আমি।
ছোট বোনটাকে বললাম, ‘বিড়াল, পড়া শোনা করিস ঠিকমতন। বাঁদরামি করিস না। সামনে ভালো রেজাল্ট হলে তুইও বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাবি।’ ১০০ টাকার একটা নোট লুকিয়ে দিলাম ওর হাতে। ‘পড়িস কিন্তু ঠিক করে।’
বিড়াল আদুরে গলায় বলল, ‘তুই সাবধানে যাইস, ভাইয়া! সামনে যখন আসবি, একটা বউ নিয়া আসিস! আর খাওয়াদাওয়া করিস ভালো করে! চাকরিটা হলে কক্সবাজারে নিয়া যাবি।’
বললাম, ‘ঠিক আছে রে।’
মা বলল, ‘তুই ওর হাতটা নষ্ট করছিস।’
বিড়াল ভেংচি কাটল।
বললাম ‘মা, আসি।’ ‘আব্বা, বের হচ্ছি’ বলে রুমে উঁকি দিলাম। দেখলাম তিনি নেই। বাইরে এসে দেখি দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি বললেন, স্টেশন যাবেন। মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মনমরা। সমস্ত মায়া বুকের ভেতর জমে উঠল আমার। এবার আর না করতে পারলাম না।
জানি কোনো কথাই কাজ হবে না। তিনি আসবেনই। স্ট্রোক করার পর তাঁর পুরোনো অভ্যাসটা আরও বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এখন আর জেদ করলে তাঁকে না করানোই যায় না।
বের হওয়ার সময় মা আমাকে যত দূর দেখা যায় দাঁড়িয়ে থাকেন। বরাবর পেছনে তাকাই না। আমার কষ্ট লাগে। বুকটা ভারী হয়ে ওঠে পাথরের মতন। এবার দুবার মায়ের মুখটার দিকে তাকালাম। আরেকবার তাকাতে মন চাইল। দেখলাম চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে আর তাকাতে পারলাম না। আমি দ্রুত পালিয়ে গেলাম অনেক দূরে।
অটোরিকশা ধরে স্টেশনে চলে এলাম আব্বার সঙ্গে। ট্রেন পৌঁছাতে চল্লিশ মিনিট দেরি। বাপ-ছেলে ছোটবেলার কত আলাপ জমালাম। স্পষ্ট ভাসছে কথাগুলো আব্বার চোখে। যেদিন জন্মগ্রহণ করেছি, সেদিন থেকে আব্বা তাস খেলেন না। সিগারেট খান না। মানুষ যদি তাঁর সন্তানকে বলে, ‘তোর বাপ এটা করে। তোর বাপ খারাপ।’ এতে আমি কষ্ট পেতে পারি। বাজারে নিয়ে এলে চা খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতাম। চামচ দিয়ে চা খাওয়াতেন। বাবার ডান হাতের আঙুল ধরে হাঁটতাম আমি।
কথাগুলো যখন বলছিলেন, তখন চোখে–মুখে এক বেহেশতের হাসি। ডায়াবেটিস, তাই মিষ্টি খেতে মানা করছি। বলল, ‘আসার সময় কালোজাম নিয়া আসিস। আর তোর মা যাতে না জানে।’
আমি ওপরে ওপরে রাগ দেখালাম। পরে বললাম, ‘আনব। কিন্তু একটার বেশি খেতে পারবা না।’
বুঝলাম মানুষ যাকে ভালোবাসে, তার শাসনে ভয় পায়। আম্মাকে কষ্টে ফেলতে চান না তিনি। আবার মানুষের মন নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষিত হয়। যেখানে নিষেধাজ্ঞা আসে, সেখানেই ব্যাকুল হয়।
তারপর আমার হাতে তিনটা হাজার টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, ‘এটা রাখ।’ বললাম, ‘ টাকা পাইছো কই?’
তিনি বললেন, ‘ওষুধের টাকা থেকে ছয় মাসে এগুলা বাঁচছে। তোর জন্য রেখেছি।’ জোর করে হাতে দিলেন।
চোখ দুটা লাল হয়ে যাচ্ছিল। নরম কাপড় ভেজার মতন আস্তে করে চোখ দুটা ভিজে উঠল। তবু নিস্তব্ধ রুক্ষতার অভিনয়।
ট্রেন চলে এসেছে। যাত্রীর চাপ কম মধ্যরাতের ট্রেন বলেই। তাড়াহুড়া না করে উঠলাম। বাবাও উঠলেন। ওপরে ব্যাগটা রেখে সিটে বসলাম। নামার আগে আব্বা কপালে জ্বরমাখা গরম ঠোঁট দিয়ে চুমো আঁকলেন।
হাত নাড়িয়ে বললেন, ‘পৌঁছে জানাইস। দরজায় দাঁড়াস না কিন্তু।’
আমিও হাত নাড়িয়ে বিদায় দিলাম।
ট্রেন ছাড়ছে। বাইরে অন্ধকার। অন্ধকার আর আলো পালাক্রমে দৌড়াচ্ছে। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। কিন্তু মেঘে ঢাকা। এই মেঘের আড়ালে মুখ গুমোট করছে আবার মাঝে মাঝে মুখ বের করে আলো ছড়াচ্ছে।
মুঠোফোন হাতে নিয়ে দেখি পাঁচটা কল তাহিয়াতের। তাহিয়াত আমার প্রেমিকা। আমাদের পাঁচ বছরের সম্পর্ক। চাকরিটার জন্য বিয়ে করা হচ্ছে না। তবে ও আমাকে যথেষ্ট সাপোর্ট দেয়। রাগ–অভিমান চলছে ইদানীং বেশি। বাড়িতে আর কত দিন কাটাব বিয়ে করব না বলে।
কল ব্যাক করতেই জিজ্ঞাসা করল, ‘ঠিক আছ তুমি?’
বললাম, ‘হ্যাঁ। ট্রেন ছাড়ল মাত্র।’
এটা শুনে হাঁপ ছাড়ল।
বলল, ‘কল ধরলে না কেন?’
‘আব্বা আজকে এ জ্বর নিয়া আসছে, তাই কল ধরিনি!’
‘আচ্ছা।’
‘সরি।’
‘আচ্ছা’
বুঝতে পারলাম ও রেগে আছে। আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হলে ও আমার প্রতিই রেগে যায়। বুঝলাম এখন ঝড় আসবে।
বলল, ‘সব সময় তুমি এমন করো। আমাকে টেনশনে রেখে তোমার শান্তি। আমার প্রতি তোমার কোনো কেয়ার নাই। আমি তো পুরান হয়ে গেছি।’
আমি চুপ। বললাম, ‘সরি, আর এমন হবে না।’
বলল, ‘আমি দেখেই এত দিন সহ্য করছি, অন্য কেউ হলে করত না। আমাকে বোকা পেয়ে এটা-সেটা।’ পুরান আমলনামা খুলে বসেছে ও।
জানি এখন যুদ্ধ চলছে। তাই মেনে নিতে হবে। আমি চুপ। চুপ থাকার জন্যও শুনতে হলো অনেক কথা।
বললাম, ‘ক্ষমা চাই, রানি আমার।’
এবার করুণা করে ক্ষমা করলেন।
এদিকে নেটওয়ার্ক খারাপ হচ্ছে ট্রেনের গতি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে।
বললাম যে কথা শুনতে পাচ্ছি না তোমার। টেক্সট করি।
‘হুম’ বলে রেখে দিল।
মেসেজে কথা হলো:
‘সরি। রাগ কোরো না।’
‘ঠিক আছে। খাইছো?’
‘হ্যাঁ। তুমি?’
‘হ্যাঁ, আমিও। মন খারাপ লাগছিল তোমার জন্য। কালকে দেখা করবা’
‘আচ্ছা কখন?’
‘বিকেলে।‘
‘আচ্ছা। আসব আগে আগেই।’
...
অনেক কথাই হলো। তারপর বলল, ‘ভাইভার পরে বিয়ে করব আমরা।
যা হওয়ার হবে।’
বললাম ‘হ্যাঁ। ঠিক আছে।’
বিয়ের পরিকল্পনা। কী কী কালারের পোশাক সব ঠিক করল। আমি সব শুনলাম বললাম, ‘ঘুমাও তুমি। আমার ফোনে চার্জ কম। তুমি ঘুমিয়ে যাও।’
মাথার ভেতর ঘুরছিল। কত সুন্দর করে মেয়েরা স্বপ্ন বোনে তার প্রিয় মানুষটার জীবনে। শাসন-শোষণে, মায়া-মমতায় আগলে রাখতে চায়। তারা অধিকারে বন্দী করে হৃদয়ে।
জীবনকে অনন্তকালের কিছু মনে হয়। আমার মনে হলো পৃথিবীটা জীবনানন্দের মায়াবী নদীর পাড়ের দেশ। কিংবা মনে হতে থাকল সুখে থাকাই জীবনের চরম সার্থকতা নয়, বরং কাউকে সুখে রাখতে পারাটাই হলো জীবনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা। পৃথিবীটা যেন নারীর মধ্য দিয়ে সুন্দর হয়ে ওঠে। অনন্ত জীবন বাঁচতে চায় কেন মানুষ? এ রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ আছে বলেই।
এরই মধ্যে শ্রীপুর স্টেশনে ট্রেন এসে থামল। এখানে সচরাচর থামে না। কী একটা সমস্যা হয়েছে বলেই থামল। দশ মিনিট বিরতি দিয়ে আবার চলছে ট্রেন। গতি যেন কাউকে ছুঁয়ে ফেলবে, কাকে ছোঁবে এ গভীর রাতের চঞ্চলতা!
দরজার কাছে এসে বাইরে তাকিয়ে দেখি চাঁদটা ডুবে গেছে প্রায়। বাইরের অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ় হচ্ছে।
শীতের কুয়াশায় চাঁদটা যেন নিস্তেজ হয়ে আছে। ভাবছি আগামীকাল কত–কী করতে হবে। তাহিয়াতের সঙ্গে দেখা। বন্ধুর বাবার কিডনির ডায়ালাইসিসে রক্ত দিতে হবে। সন্ধ্যাই জ্যাম ঠেলে যেতে হবে টিউশনে। কারণ, স্টুডেন্টের জন্মদিন, বাচ্চাটা খুব অনুরোধ করেছে যাওয়ার জন্ম। আর ওই দিন বলল, ‘একটা কথা দিন স্যার, আমার জন্মদিনে অবশ্যই আসবেন! না এলে খুব মন খারাপ করব। বার্থ ডে কেকই কাটব না।’ তাই আমি আর ‘না’ করতে পারিনি। অবশ্য বাচ্চাটার জন্মদিনের কথা ভেবে কিছু চকলেট, আর একটা নীল রঙের পুতুল কিনে এনেছি। তা এখন ব্যাগে আছে। আবার ভাইভার স্যুটের জন্য যেতে হবে কলাবাগান। কত কাজ আর কীভাবে করব আমি। কত দিন আড্ডা দেওয়া হয় না বন্ধুদের সঙ্গে। যাক, রাতে দেরি হলে ওদের ওখানেই উঠব। একটা আড্ডা তো হবে। এ মানুষগুলা মিলেই তো জীবন আমার।
আমার চোখে তখন চাঁদের দেখা নেই। ভাওয়ালের শালবনের শক্ত বৃক্ষের নিকষ কালো অন্ধকারে হারিয়ে গেছে সে। মনে হয় কেউ একজন চাঁদটাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে হায়েনার মতন।
যেন ঘুম আর জাগরণের মিশ্রণে মহাজাগতিক স্বপ্ন দেখছি। বাইরে প্রাচীন অন্ধকার। এক অপরিচিত অন্ধকার।
সিটে গিয়ে বসলাম। এক গভীর স্বৈরাচারী নিদ্রা নামল আমার দুচোখে। অন্য যাত্রীদের চোখেও তা–ই, মনে হয় আফিম খেয়ে ঘুমিয়ে আছে ওরা। মনে হলো ওদের ঘুম গন্তব্যে গিয়েও ভাঙবে না আর।
এদিকে ট্রেন চলছে। আধো জাগরণ আধো নিদ্রায় শুনলাম এটি সামনের স্টেশনে দাঁড়াবে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে। কে বলছে? বুঝলাম ট্রেনে থাকা স্পিকার থেকে জানানো হচ্ছে। চাদরটা শক্ত করে পেঁচিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করলাম।
ঘুম ভাঙল হঠাৎ হইচই শব্দে। তারপর শুনলাম আগুন, আগুন। বাঁচাও, বাঁচাও। চোখ খুলে দেখি একটা কোলে থাকা শিশুসহ এক নারী আগুনে জ্বলছে। তার মুখটা পুড়ে প্রায় ছাই হয়ে গেছে। শিশুটির চুলগুলো আগুন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। আগুন এখানে ক্ষুধার্ত মায়া-মমতা, বন্ধন, জাত ভুলে গ্রাস করছে একের পর এক।
বাইরে থেকে কারা জানি আগুন জ্বালিয়ে ভেতরে ছুড়েছে। মুহূর্তের মধ্যে ট্রেনটায় আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। আমার নামার উপায় ছিল না। নিরাপত্তার জন্য এক দরজা বন্ধ ছিল। চোখের সামনে দেখলাম ট্রেনের কামরাটা মানুষের লালসার আগুনে জাহান্নাম হয়ে গেল। আপ্রাণ চেষ্টা করছি বের হতে। জানালার কাচ ভাঙতে গিয়ে হাত ফেটে রক্ত ঝরছে ফিনকি দিয়ে। কালো ধোঁয়ায় সব অন্ধকার। আমার চাদরটায় আগুন দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করল। দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না। হাত-পা পুড়ে বুকে প্রবেশ করছে। মৃত্যু–জীবন পালাক্রমে সংগ্রাম করছে। আগুন ধরতে শুরু করেছে কলিজা আর ফুসফুসে। মাংসগুলোও আরও বেশি জ্বলছে চর্বি থাকায়। তারপর হাড়গুলায় আগুন প্রবেশ করল। পুড়ে পুড়ে অবশিষ্ট এক হাড়ের কাঠামো। মানুষ আর স্বপ্নপোড়া দুর্গন্ধ। বীভৎস! যা ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য। মনে হয় অন্য কোনো জাতির কেউ পুড়িয়ে আনন্দ পাচ্ছে এ মানুষগুলোকে। এক পৈশাচিক আনন্দ। তার চিৎকারের শব্দ কমতে কমতে একসময় নেমে এল এক নৈসর্গিক নীরবতা।
হঠাৎ কারা এসে আগুন নিভিয়ে দিল। কিন্তু ততক্ষণে কঙ্কালে পরিণত হয়ে গেলাম আমি। আমি বলছি কেন এ কামড়ার প্রায় সবাই ক্ষমতার জাহান্নামে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। মানুষের পরিচয় তার কোমল মাংসের উপস্থিতিতে। সাদা–কালো মাংস দ্বারা যে পরিচয়, যা দ্বারা তাকে চিনতে পারা যায়। কারণ, সব মানুষের কঙ্কাল প্রায়ই একই রকম দেখতে। আমার মতন আরও কিছু কঙ্কাল দেখলাম। জানি আমাদের কেউ শনাক্ত করতে পারবে না। শনাক্ত করলেই কী আর?
কপালে হাত দিয়ে বাবার দেওয়া চুমুটা খুঁজছি। অন্য কঙ্কালগুলোর কপালেও ওদের প্রিয় মানুষের চুম্বন আছে, ওরাও কি তা খুঁজছে?
বুঝতে পারলাম খুন করা হয়েছে আমাদের। আমার এক সাংবাদিক বন্ধু কালকে কঙ্কাল নিয়ে সংবাদ করবেন। সার্কুলেশন হলে তাঁর আয় বাড়বে! সরকারি দল ও বিরোধী দল ভোট সংগ্রহ করবে। আমাদের নামে কাদা-ছোড়াছুড়ি হবে। সত্য থেকে যাবে ঈশ্বরের কাছে। ক্ষমতার পিপাসা মেটাতে মানুষের রক্তে পিপাসা মেটায় মানুষ! মায়ের কোল খালি করে শক্ত হয় ক্ষমতার মসনদ। এটা যে দলেরই হোক! এটা গণতন্ত্রের আমলে বা স্বৈরতন্ত্রের কিংবা সামরিক শাসনে। পৃথিবীতে রাষ্ট্র ছিল না যখন, তখনো মানুষের রক্তেই বানানো হতো ক্ষমতার পাহাড়। আর সে পাহাড় বিক্রি করত তাদের পরের প্রজন্ম।
মুঠোফোনটা পুড়ে গেছে।
মা কল দিয়ে যাচ্ছেন। হয়তো আমার ফেরার অপেক্ষায় আছেন। নিরাপত্তা বাহিনী থেকে জানিয়ে দেওয়া হবে, ‘কঙ্কালগুলো শনাক্ত করে ফিরিয়ে দেব আপনাদের পরিবারের কাছে।’
তাহিয়াত উন্মাদের মতন খুঁজছে আমার উপস্থিতি। কয়েক মাস পরের বিয়ের সানাইয়ের সুর বাজছে ওর কানে। ওর কান্না করা কী খুব সহজ! ও পাথর হয়ে গেল ফেরাউনের পিরামিডের দিকে তাকিয়ে।
স্বপ্নগুলো খুন করে দিল কারা? কেন? ক্ষমতা না অন্য কোনো বিমূর্ত কিছু সবাই জানে, কেউ বলবে না!
লাশটা চেনার উপায় নেই। শুধু কঙ্কালটা বাকি! মা কি চিনবেন আমাকে আর?
একদিন পর আমার কঙ্কালের মতন একটা কঙ্কাল বাড়িতে পাঠানো হলো! মা কঙ্কালটা ধরে ‘ও বুকের মানিক রে’ বলে মূর্ছা যাচ্ছেন! ‘ও আল্লাহরে কী করলা আমার বুকের ধনরে!’ গগনবিদারী চিৎকার আর অভিশাপে বাতাস হু হু করে উঠছে।
যে কঙ্কালটা বুকে নিয়ে মা কাঁদছেন, আব্বার দাড়ি ভিজছে বারবার যে কঙ্কালটার দিকে তাকিয়ে, ছোট বোনটা যে কঙ্কালটা দেখে ভয় পাচ্ছে, বারবার সেন্সলেস হচ্ছে, সে কঙ্কালটা বলল, ‘আমি আপনার ছেলে নই। আমার মা বেঁচে নেই। আগুনে পুড়ে সে–ও কঙ্কাল হয়ে গিয়েছে। আর আমার মায়ের কঙ্কালের সঙ্গে চলে গেছে আপনার ছেলের কঙ্কাল।’
এরই মধ্যে এক অপরিচিত বৃদ্ধ এসে ভারী স্বরে বলল, ‘ওর কবর খোড়া শেষ।’
কঙ্কালটা দাফন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল সবাই। তখন আব্বা দৌড়ে এসে কঙ্কালটার কপালে জ্বরমাখা ঠোঁট দিয়ে এক অন্তিম চুম্বন আঁকলেন
তখন দূর থেকে চিৎকারের শব্দ ভেসে আসছে, ‘মা-বাবা! আমরা মরিনি। আমাদের খুন করেছে রাষ্ট্র। মা ভুল কঙ্কাল ধরে কেঁদো না। তোমরা রাষ্ট্রের কঙ্কাল ধরে কাঁদো!’
লেখক: মো. শওকত হোসেন, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়