বাংলাদেশের ক্রিকেট: প্রত্যাশা বনাম বাস্তবতা

মুশফিক ও তাসকিন
ছবি: এএফপি

সম্প্রতি বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেন সমালোচনার ঝড় বইছে। কেননা, বাঙালিদের সমালোচনায় বিশেষ খ্যাতি আছে। আর হবেই না কেন? এ দেশের মানুষের আবেগ-অনুভূতির একটা বড় জায়গা দখল করে আছে ক্রিকেট। আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে এনামুল হক জুনিয়রের এক টেস্টে ১০ উইকেট প্রাপ্তির খবরে আমার মতো সবাই যেমন আনন্দিত হয়েছে, তেমনি বড় দলের সঙ্গে ভরাডুবিতে সমানতালে ব্যথিত হয়েছে।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশ টেস্ট খেলুড়ে দেশের মর্যাদা লাভ করে। এরপর মাঝখানে পাড়ি দিয়েছে দীর্ঘ পথ। এই সময়ে দল হিসেবে ব্যর্থতার পাল্লা ভারী হলেও চমকপ্রদ ও আশাজাগানিয়া বেশ কিছু অর্জনও রয়েছে বাংলাদেশের ঝুলিতে।

টেস্ট ক্রিকেটে সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে আশরাফুলের শতরান, ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে সোহাগ গাজীর একই টেস্টে হ্যাটট্রিক ও শতরান, আবুল হাসানের অভিষেক ম্যাচে দশম ব্যাটসম্যান হিসেবে শতরান, একই টেস্টে সাকিবের ১০ উইকেট ও শতরান, ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে সাকিবের একই সঙ্গে ওয়ানডে, টেস্ট ও টি-টোয়েন্টির সেরা অলরাউন্ডার নির্বাচিত হওয়া ইত্যাদি সমীহ জাগানো রেকর্ড রয়েছে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের। আবার টেস্ট ক্রিকেটে টানা ২১ ম্যাচে হার, শ্রীলঙ্কার এক দিনে ৫০৯ রান সংগ্রহ, দলীয় শূন্য রানেই প্রথম তিন উইকেট পতন, টানা ১৬ সিরিজ পরাজয়, এক ইনিংসে পাকিস্তানের পাঁচ ব্যাটসম্যানের শতরান, ওয়ানডেতে চামিন্দা ভাসের প্রথম ওভারেই চার উইকেট প্রাপ্তি ইত্যাদি বাজে রেকর্ডও বাংলাদেশের দখলে।

সাকিব-মাহমুদউল্লাহ
ছবি: রয়টার্স

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পারফরম্যান্সের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। সেই সঙ্গে দেশের মানুষের ক্রিকেট ঘিরে ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে প্রত্যাশার পারদ। কিন্তু টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফর্ম করতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে এক দিনের ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে ভালো করতে থাকে বাংলাদেশ। বিশেষ করে ২০১০ সালের পর ওয়ানডে ক্রিকেটে আশাজাগানিয়া ফলের প্রদর্শনী পাওয়া যায় বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে। পরিসংখ্যান বলে, ২০১০ সালের পর থেকে দেশে অনুষ্ঠিত ২৬টি দ্বিপক্ষীয় সিরিজের ১৮টিতেই জয়লাভ করে বাংলাদেশ। বিশেষ করে ২০১৪ সালে মাশরাফি বিন মুর্তজা দলের অধিনায়ক হওয়ার পর প্রাপ্তির পালে ঝোড়ো হওয়া বইতে থাকে। তাঁর অধীনে উড়ন্ত পারফর্ম করতে থাকে বাংলাদেশ। মাশরাফির অধিনায়কত্বে অনুষ্ঠিত হওয়া ৮৮ ম্যাচের ৫০টিতে জয়, ৩৬টিতে পরাজয়ের বিপরীতে দুটি ম্যাচ ড্র করে বাংলাদেশ। ধীরে ধীরে দেশের বাইরেও পারফরম্যান্সের ফুলঝুরি ফোটাতে থাকে বাংলাদেশ। এশিয়া কাপের ফাইনালে গিয়েও অল্পের জন্য শিরোপা জেতা হয়নি আমাদের। শ্রীলঙ্কার মাটিতে দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজ ড্র, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজ জয়, আয়ারল্যান্ডের মাটিতে ত্রিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজ জয়সহ দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পর প্রত্যাশার পারদে আগুন লাগে বাংলাদেশি সমর্থকদের। বড় টুর্নামেন্টে শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখতে থাকেন তাঁরা।

কিন্তু এত কিছুর পরও পরিসংখ্যানের তথ্যমতে, বাংলাদেশ গড়পড়তা মানের একটি দল। বড় কোনো টুর্নামেন্ট জয়ের জন্য খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত যে পরিসংখ্যান থাকা দরকার, তা কিন্তু বাংলাদেশ দলে অনুপস্থিত। জানি, অনেকেই আমার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করবেন, তাই আপনাদের জ্ঞাতার্থে নিম্নোক্ত তথ্যগুলো উপস্থাপন করছি।

তাসকিন আহমেদ ও সাকিব আল হাসান
ছবি: শামসুল হক

চলতি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো পারফর্ম করা ভারতীয় দলের সঙ্গে বাংলাদেশ দলের পরিসংখ্যানগত পার্থক্যটা দেখুন। ভারতীয় দলে যে ৭ জন স্বীকৃত ব্যাটসম্যান রয়েছেন, তাঁদের ওয়ানডে ক্রিকেটে ব্যাটিং গড় এবং শতরানের পরিসংখ্যান এ রকম: রোহিত শর্মা (গড় ৪৯.০৯, শতক ৩১), শুবমান গিল (গড় ৬১.০৩, শতক ৬), বিরাট কোহলি (গড় ৫৮.৪৮, শতক ৪৯), লোকেশ রাহুল (গড় ৪৮.৭৭, শতক ৬), শ্রেয়াস আইয়ার (গড় ৪৬.৫৩, শতক ৩), ঈশান কিশান (গড় ৪২.৪১, শতক ১), সূর্যকুমার যাদব (গড় ২৬.৮৬, শতক ০)।

এবার চলুন বাংলাদেশ দলের ৭ জন ব্যাটসম্যানের পরিসংখ্যানটা একটু দেখে নিই: নাজমুল শান্ত (গড় ৩০.১৪, শতক ২), তানজিদ তামিম (গড় ১১.৯২, শতক ০), লিটন দাস (গড় ৩১.৬২, শতক ৫), মুশফিকুর রহিম (গড় ৩৬.৪৮, শতক ৯), সাকিব (গড় ৩৭.১২, শতক-৯), মাহমুদউল্লাহ (গড় ৩৬.১৬, শতক ৪), তাওহিদ হৃদয় (গড় ৩৩.৭৮, শতক ০)।

এবার ভারতীয় বোলারদের শুধু বোলিং গড়টা (অর্থাৎ একটি উইকেটের বিপরীতে খরচ করা রান) একবার দেখুন: মোহাম্মদ সিরাজ (গড় ২১.৮৬), মোহাম্মদ শামি (গড় ২৩.৯২), প্রসিদ্ধ কৃষ্ণ (গড় ২৫.৫৯), যশপ্রীত বুমরা (গড় ২৩.৪), কুলদীপ যাদব (গড় ২৫.৪), রবিচন্দ্র অশ্বিন (গড় ৩৩.২১), রবীন্দ্র জাদেজা (গড় ৩৫.৬৯), শার্দুল ঠাকুর (গড় ৩০.৯৮)।
এবার বাংলাদেশে বোলারদের গড়টা একনজরে দেখে নেওয়া যাক: তাসকিন আহমেদ (গড় ৩০.৬), শরিফুল ইসলাম (গড় ২৮.০৪), মুস্তাফিজুর রহমান (গড় ২৫.৬৮), নাসুম আহমেদ (গড় ৩৮.৭৫), মেহেদী মিরাজ (গড় ৩৩.৮৪), শেখ মেহেদী (গড় ২৮.৪৩), সাকিব (গড় ২৯.৫৩)।

মোটামুটি সব বড় দলের সঙ্গেই দেশের খেলোয়াড়দের পরিসংখ্যানগত পার্থক্যটা ঠিক ওপরের তথ্যগুলোর মতোই। এক দিনের ক্রিকেটে শুধু কোহলির শতরানের সংখ্যা (৪৯), যা বাংলাদেশের সব খেলোয়াড়ের শতরানের যোগফলের (সাকিব ৯ + মুশফিক ৯ + মাহমুদউল্লাহ ৪ + লিটন ৫ + শান্ত ২ + মিরাজ ২ = ৩১) চেয়ে অনেক বেশি। ভালো পারফর্ম করা প্রতিটা বড় দলে ৫-৬ জন করে ৪০+ গড়ের ব্যাটসম্যান, ৩-৪ জন ২৫–এর নিচে গড়ধারী বোলার বর্তমান। অথচ আমাদের দলে একজনও এ রকম পরিসংখ্যানধারী খেলোয়াড় নেই। যে দলের খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত পরিসংখ্যান যত উন্নত, সে দলের দলীয় ফল ততটাই মজবুত হবে, এটা সহজেই অনুমেয়।

সুতরাং ওপরের তথ্য-উপাত্ত থেকে এটা সহজেই বোধগম্য যে দেশের খেলোয়াড়েরা তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী পারফর্ম করে যাচ্ছে আর খারাপ ফলের জন্য শুধু খেলোয়াড়দের বলির পাঁঠা বানানো সমীচীন হবে না অথবা একতরফাভাবে খেলোয়াড়দের সমালোচনা বাতুলতা বৈ অন্য কিছু নয়।

ভালো ক্রিকেট ও মানসম্মত ক্রিকেটার তৈরির পূর্বশর্ত হলো ভালো মানের ঘরোয়া লিগ, সঙ্গে চমৎকার অবকাঠামোগত সুবিধা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দুটোই বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনুপস্থিত। আর আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে স্বেচ্ছাচারিতা, ক্লাবের হর্তাকর্তাদের সীমাহীন দুর্নীতি, মানহীন ক্রিকেটারের দৌরাত্ম্য, পক্ষপাতদুষ্ট আম্পায়ারিংয়ের কথা কারও অবিদিত নয়।

দেশের কথা বাদ দিলেও শুধু ভারতের মহারাষ্ট্র, গুজরাট অথবা অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া রাজ্যের ক্রিকেট অবকাঠামো বাংলাদেশের চেয়ে ঢের উন্নত। আর আমাদের ক্রিকেট অবকাঠামো হলো, চারদিকে কংক্রিটের দেয়াল আর মাঝখানে এক-দুটি মানহীন উইকেট। আর এখানেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন আমাদের ক্রিকেটাররা। অথচ ভারতের রঞ্জি ট্রফি, দিলীপ ট্রফি, অস্ট্রেলিয়ার রাজ্যভিত্তিক দ্য শেফিল্ড শিল্ড লিগ প্রভৃতি ঘরোয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্টে যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ হয়ে থাকে।

২ কোটি জনসংখ্যার ঢাকা শহর অথচ মিরপুরের ছোট্ট একচিলতে সবুজ একাডেমির বাইরে খেলোয়াড়দের অনুশীলনের দ্বিতীয় কোনো জায়গা নেই। ২০১১ সালের ওয়ানডে ক্রিকেট বিশ্বকাপের জন্য ৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংস্কার করা হয়। এখন ২০২৩ সাল, মাঝের এই ১২ বছরে ওই স্টেডিয়াম আরও কতবার সংস্কার করা হয়েছে, একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন। এখনো সংস্কার কাজ চলছে ও অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে! অথচ হলফ করে বলতে পারি এই ১২ বছর সংস্কারের নামে যতবার এবং যতগুলো অর্থ অপচয় করা হয়েছে, সেই টাকা দিয়ে একটি নতুন, মানসম্মত, টেকসই স্টেডিয়াম অনায়াসে তৈরি করা যেত। দেশের জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বানানো ফতুল্লা স্টেডিয়াম পানির নিচে বছরের পর বছর ডুবে থাকে, কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করে বিদেশ থেকে আনা চেয়ার খুলনা স্টেডিয়ামের গ্যালারি থেকে হওয়া হয়ে যায়! অথচ অনুশীলনের জন্য বল ছোড়ার মেশিন না পেয়ে ইমরুল কায়েসের ক্ষোভ উগড়ে দেওয়ার কথা আমরা সবাই জানি।

ভাবতে অবাক লাগে, ২৩ বছর আগে টেস্ট খেলুড়ে দেশের মর্যাদা পেলেও ক্রিকেটের জন্য ভালো অবকাঠামো, আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা, মানসম্মত ঘরোয়া ক্রিকেট লিগ তৈরি করতে পারিনি আমরা। অথচ এগুলো ভালো ক্রিকেটার তৈরির পূর্বশর্ত। যত দিন না আমরা এসব শর্ত পূরণ করতে পারছি, তত দিন আমরা একজন রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি, বাবর আজম অথবা রশিদ খান তৈরি করতে পারব না। আর তত দিন বড় টুর্নামেন্টে আমাদের পারফরম্যান্সের গ্রাফেও কোনো পরিবর্তন হবে না।