দেশের এ মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে কী ভূমিকা রাখতে পারি?

ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বন্ধুসভার উদ্যোগে শুকনা খাবার বিতরণছবি: বন্ধুসভা

দেশে ঘটে যাওয়া আন্দোলন ও সহিংসতায় অনেকের মধ্যে অসহিষ্ণুতার প্রভাব দেখা দিয়েছিল। ফলে নিজেদের নিরাপত্তায় দেশের বৃহত্তর বাহিনী পুলিশের অনেক সদস্য ভয়ে থানায় ছিলেন না।  তাঁদের অনুপস্থিতিতে সেনাবাহিনীর একার পক্ষে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এ সময় সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থী ও স্বেচ্ছাসেবীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নামে। তারা খুঁজছে সঠিক নির্দেশনা ও নেতৃত্ব। একমাত্র আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই পারি নিজেদের দীক্ষা-দক্ষতা, ক্যাম্পাস জীবনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে তাদের সঠিক নেতৃত্ব দিতে। দেশের ৬৪ জেলাতেই সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই ছড়িয়ে আছে। প্রত্যেকেই যদি নিজ নিজ এলাকায় সঠিক দায়িত্ব নিয়ে যথাযথ নেতৃত্ব নিশ্চিত করতে পারি, তবে আমাদের হাত ধরেই একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। এ ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে আমার কিছু মতামত তুলে ধরছি—

১.

আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের নিয়ে নিজ এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় একটি বলয় তৈরি করতে পারি। এখানে আমাদের কাজ হবে নিকটস্থ সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নিয়ে সে অনুযায়ী শিক্ষার্থী, জনতা ও আগ্রহী স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব বণ্টন ও নির্দেশনা দেওয়া।

২.

নিজ নিজ এলাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা, পরিচ্ছন্নতা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। স্কুল-কলেজের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীকে সক্ষমতা অনুযায়ী শিফটভিত্তিক বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত করে তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া।

৩.

নিজ নিজ এলাকায় স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, সাধারণ জনগণ ও স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কমিউনিটিভিত্তিক ফেসবুক/মেসেঞ্জার গ্রুপ গড়ে তোলা এবং সে গ্রুপের মাধ্যমে সবার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ নিশ্চিত করা। জরুরিভাবে রক্তের প্রয়োজন মেটাতে এ গ্রুপের সদস্যদের মোবাইল নম্বর–ফেসবুক প্রোফাইল ও রক্তের গ্রুপ নিয়ে ডেটাবেস তৈরি করে রাখা যায়।

৪.

এলাকায় নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের দায়িত্বরত এলাকার বর্তমান পরিস্থিতির ছবি ও ভিডিও ফুটেজ তাদের জন্য নিয়োজিত ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করা। সেগুলো প্রতিনিয়ত তদারক করে তাদের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া।

৫.

সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও আক্রান্ত পরিবারের মধ্যে সাহসের সঞ্চার ঘটানো এবং তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

৬.

এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ দোকানপাট, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ব্যাংক ও অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান; ধর্মীয়, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন স্থাপনায় নজরদারি বাড়ানো এবং এসব স্থান তদারকিতে যারা আছে; তাদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

৭.

রাতে নিজের বাড়ি ও বাড়ির আশপাশ এবং নিকটস্থ ধর্মীয় উপাসনালয়, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে নজরদারি করা। কোথাও অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লে তা নিজেদের ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট করা এবং নিয়োজিত নিকটস্থ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দ্রুততার সঙ্গে তা জানানো।

৮.

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জেলাভিত্তিক অ্যাসোসিয়েশনকে কাজে লাগিয়ে সেখানে নিজ জেলার মধ্যে এ কার্যক্রমগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় সমন্বয় করা যায়।

৯.

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাব ও সংগঠনের পক্ষ থেকে তাদের ক্লাব সদস্যদের নিজ এলাকায় শিক্ষার্থীদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় উৎসাহিত করা যায়।

১০.

প্রত্যেক স্বেচ্ছাসেবী নারী শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো নারী স্বেচ্ছাসেবী যেন আমাদের দ্বারা কোনোভাবে নিগৃহীত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

১১.

প্রত্যেকের মতামতের প্রতি আমাদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। এমনকি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মতামতকেও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। যুক্তিযুক্ত মতামত বা প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

১২.

এ ধরনের কাজে কোনো রকম সহিংসতা বা ঔদ্ধত্য প্রকাশ করা যাবে না। কোনো ব্যাপারে দ্বিমত দেখা দিলে তা দ্রুত নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিষ্পত্তি করতে হবে।

১৩.

দুষ্কৃতকারীদের প্রতি চড়াও না হয়ে তাদের আটক করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোপর্দ করতে হবে।

১৪.

কোনোভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না। জরুরি প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে হবে।

১৫.

এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ধর্মীয় এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক ও অন্যান্য শ্রেণি–পেশার মানুষের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও উপদেশ গ্রহণ করে সে অনুযায়ী কাজ করতে পারি।

এসব কাজের প্রতিটিতেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড বা অথবা কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে ভূমিকা রাখলে সে সংগঠনের অনুমোদন এবং সাথে সে সংগঠনের আইডি কার্ড রাখাটা বাঞ্ছনীয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের লেবাস নিয়ে কোনো দুষ্কৃতকারী যেন কোনো অনিষ্ট সাধন না করতে পারে; সে জন্য স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থী ও সংগঠকদের পরিচিতিস্বরূপ সঙ্গে আইডি কার্ড বহন করা উচিত। এভাবেই আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে একটি সুস্থ-সুন্দর বাংলাদেশ গড়ায় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখতে পারি।

অনেকে আন্দোলনে অংশ নিতে পারিনি নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে। তাতে দুঃখের কোনো কারণ নেই। কারণ, এ দায়িত্ব আন্দোলনের অংশ নেওয়ার থেকেও কোনো অংশে কম নয়। এ দায়িত্ব যারা যথানিয়মে পালন করতে পারব, তাদের ভূমিকাকে ইতিহাস কখনো ছোট করে দেখবে না। কারণ, এ দায়িত্ব আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার দায়িত্ব। তাই আমি মনে করি, এত দিন যে যা করেছি, সব ভুলে যাই। আজ থেকে সবাই মাঠে নামি। একমাত্র আমরা শিক্ষার্থীরাই পারি এ বাংলাদেশকে রক্ষা করতে।

লেখক: মো. নাঈম হোসেন চৌধুরী, শিক্ষার্থী, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়