জাদুর শহর ঢাকা
ঢাকা। কেউ বলে জাদুর শহর, কেউ বলে রিকশার শহর, আবার কেউ বলে মসজিদের শহর।
কেউ কেউ অবশ্য ঢাকাকে মিথ্যার শহরও বলে। তবে, এই শহরকে আমার প্রেমিকের মতো মনে হয়।
প্রেমিক তাঁর প্রেমিকাকে আঁকড়ে ধরে। ভালোবেসে ফুল দেয়। প্রিয় মানুষকে নিয়ে কাব্য লিখে, গল্প লিখে।
আবার কখনো কখনো এই সম্পর্কে টানাপোড়েন চলে। ছন্দপতন ঘটে। এক সমুদ্র যন্ত্রণায় বিদীর্ণ হয় হৃদয়।
ছন্দপতন পেরিয়ে আবার সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়।
নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পরও প্রেমিকে যেমন ছাড়া যায় না, ঢাকা শহর আমার কাছে তেমনই। ঢাকা শহরের প্রতি আমার ভালোবাসা অনেকটা আসক্তির মতো।
এই শহর স্বপ্নের শহর। আবার দুঃস্বপ্নেরও। স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন নিয়েই তো জীবন। স্বপ্ন-দুঃস্বপ্নের মিশেলে ঢাকা আমার কাছে এক মায়ার শহর। কোনো কিছুতে এই মায়া কাটে না।
সাদা-কালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে প্রেমিকেরা বেকারত্ব-হতাশার পাশাপাশি আশায়ও বুক বাঁধে। তাঁরা জীবন নিয়ে লাল-নীল সংসারের স্বপ্ন দেখে এই শহরে।
গ্রাম থেকে এই শহরে হাজারো মানুষ আসে প্রতিদিন। কেউ আসে মাথা গোঁজার একটু ঠাঁই খুঁজতে। তাঁরা আপনজনের মায়া পেছনে ফেলে যান্ত্রিকতায় ভরা এই শহরে অস্থায়ী ঠিকানা খুঁজে নেয়।
দূরপাল্লার বাস পেছনে ফেলে তাঁরা ঢাকায় এসে নানা নামের লোকাল বাসের যাত্রী হন। এসব লোকাল বাসে গাদাগাদি করে চলার মতোই এই শহরের জীবন।
কোথায় যেন পড়েছিলাম, ঢাকা শহরের মানুষ নাকি রাস্তায় হাসে না। কল্পনায় বিষয়টি ভেবে বিস্মিত হই। লক্ষ করি, এই শহরের মানুষ প্রতিদিন যন্ত্রের মতো ছুটছে। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তাঁদের সে কী সংগ্রাম।
অজস্র ভিড়ের শহরের মানুষ নাকি স্বার্থপর হয়। সে তো হতেই পারে। এ ক্ষেত্রে আমার একটা যুক্তি আছে। যে শহরকে ইট-পাথরের মতো শক্ত পদার্থ চেপে আছে, সে শহরের মানুষের হৃদয় কোমল না হয়ে কঠিন হওয়াই তো যুক্তিসংগত।
ঢাকার অন্যতম প্রধান সমস্যা যানজট। ঢাকার এই যানজট নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত সবাই। তবে আমার হয় উল্টো। আমার কাছে ঢাকা শহরের সবচেয়ে প্রিয় বিষয়—যানজট।
যানজটে হাজারো গাড়ি, মানুষ আটকা পড়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নষ্ট হয় এই যানজটে। এই যানজটে বসেই মানুষ সময়ের সর্বোচ্চ মূল্য অনুভব করে।
যানজটে আটকে থাকা মানুষের দিকে আমি তাকাই। দেখি, এত এত মানুষ, অথচ কী আশ্চর্য, কেউ কাউকে চেনে না।
কেউ রিকশায় বসে রোদে পুড়ছে। কেউ গাড়িতে বসে বিশেষ যন্ত্রের কল্যাণে হাওয়া খাচ্ছে। তবে সবার মধ্যে একটা মিল আছে। সবার চেহারায় বিরক্তি আর অস্থিরতার ছাপ।
আমি এই যানজটে বসে মানুষের গল্প শুনি। ব্যর্থতার গল্প, জীবন গড়ার গল্প।
আমার কাছে এই শহরের সবচেয়ে বড় গল্পকার রিকশাচালক। তাঁদের জীবন আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তাঁদের জীবন মানেই নিরন্তর সংগ্রাম।
ঢাকার সব অলিগলিতেই গল্প উড়ে বেড়ায়। সকাল, সন্ধ্যা কিংবা রাত—সব সময়ই মেলে নানান সব গল্প। আনন্দ, বেদনা, আশা, হতাশা, রহস্য, রোমাঞ্চ—কী নেই এই গল্পে।
এই শহরে চাওয়ার সঙ্গে পাওয়া মেলে না। ফলে প্রতিদিনই এই শহর আমাদের আহত করে। যোগ-বিয়োগের হিসেবে বড় ফারাক থাকলেও এই শহরকে কেন যেন ছাড়া যায় না।
আমি ঢাকাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এই হাহাকার ভরা শহরের অলিগলি, ইট-পাথরের কঠিন কাঠামো, ভবনের ফাঁকে চাঁদের এক চিলতে আলো, ল্যাম্পপোস্টের কৃত্রিম আলো—সব আমাকে টানে।
আমি ভালোবেসে ফেলছি, এই শহরের ফুটপাতকে, ভালোবেসে ফেলেছি যান্ত্রিক জীবনকে।
বাসস্টপের নাগরিক সন্ধ্যা, হাজার ভিড়ের মধ্যে শূন্যতা আমাকে অভ্যস্ত করে তুলেছে।
এই শহর আমাকে দিয়েছে সংগ্রামী জীবন। এই জীবন আমাকে গ্রাস করেছে। এই শহর আমাকে জাদু করেছে।