ঢাকায় থেকে ফাঁকায় বসে অফিস করি

‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া একটি ধানের শিষের ওপরে একটি শিশিরবিন্দু।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি শিশির বিন্দু কবিতার এই পঙ্কক্তির মাঝে কাছাকাছি অচেনা - অদেখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আভাস পাওয়া যায়। আমাদের মাঝে অনেকেই বিদেশ ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। অথচ তাঁদের হয়তো জানা নেই, তাঁর আশে পাশেই অনাবিষ্কৃত আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ডিব্বা।

বাড্ডার বড় বেরাইদ এলাকায় অবস্থিত ফর্টিস গ্রুপে আসলে প্রথমে রবীন্দ্রনাথের বহুল ব্যবহৃত এই কবিতাটির কথায় মনে পড়ে। কোম্পানির অধীনস্থ ফর্টিস ডাউন টাউন রিসোর্ট ও ফর্টিস এফসি লিমিটেডের মখমলের মতো বিছানো সবুজ ঘাসের মাঠে ঢুকে পড়লে আপনি বলতে বাধ্য, ‘আরে এ তো ঢাকার মধ্যে অন্য ঢাকায় চলে আসলাম!’ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের নবাগত ক্লাব ফর্টিস এফসি লিমিটেডের ম্যানেজার হিসেবে যে অন্য ঢাকায় আমার কর্মস্থল।

রাশেদুল ইসলাম

যে ঢাকায় মাথার ওপর ঢাকনা বিহীন ঝাঁ চকচকে অনেক বড় আকাশ। কখনো পেঁজা তুলোর মতো মেঘের দলের আনাগোনা। আকাশ থেকে চোখ জোড়া নামিয়ে ঘুরালে চারপাশে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থেকে সবুজ মাঠটিকে পাহারা দিচ্ছে সারি সারি সবুজ গাছ। দূর থেকে ভেসে আসছে পাখির গান। আপনি যদি আমার মতো রস কস বিহীন সরস মানুষও হন, সে গাছের বেড়ার ফাঁক গলে উঁকি দিয়ে ডাকতে থাকা কাশফুলগুলোও আপনাকে ডাকবে। আবার ছোট বেলায় টিবির পর্দায় দেখা, ‘যেন কাশফুলের নরম ছোঁয়া’ বিজ্ঞাপনের কথা ভাববেন না। সবকিছু মিলিয়ে সবুজের সমারোহর মধ্যে মন খুলে বিশুদ্ধ অক্সিজেন নেওয়ার মতো একটা জায়গা! মাঝে মাঝে মনে হয় ,কেজির এককে বিশুদ্ধ অক্সিজেন বিক্রির সুযোগ থাকলে অনায়াসে অক্সিজেন সরবরাহ করে লিওনেল মেসি বা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে কিনে ফেলতে পারত আমার প্রিয় ফর্টিস এফসি ক্লাব!

প্রথম দিন এখানে এসে নিজেকে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মতো মনে হচ্ছিল। ভাবখানা এমন, ‘ঢাকার মধ্যে নতুন ঢাকা’ আবিষ্কার করে ফেলেছি। জায়গাটির সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিন ‘ইনভেনশন’ না ‘ডিসকাভার’ শব্দ ব্যবহার করব; তা স্কুলে পড়ার দিনগুলোর মতো গুলিয়ে ফেলছিলাম। আমেরিকা আবিষ্কারের পর কলম্বাসের কি রকম আনন্দ হয়েছিল, তর্কের খাতিরে কলম্বাস ছাড়া তা শুধু আমার কলেজ প্রভাষক বউ-ই আন্দাজ করে বলতে পারবেন। কারণ তাঁর মতো সুন্দর করে আন্দাজি কথা বলার (আমার ব্যাপারে) মানুষ আমি দেখিনি। তবে তাঁর কাছে ফর্টিসের গল্প বলার সময় আমার চোখে মুখে যে আনন্দের আভা খেলা করছিল , তা দেখেই সে বুঝে গিয়েছিল আমার ভেতরের ফর্টিস মুগ্ধতা।

দেশের ফুটবল আমার সর্বোচ্চ আবেগ ও ভালোবাসার জায়গা। পেশাগতভাবে সেই ফুটবলের সঙ্গে যদি থাকে বড় আকাশ আর সবুজ মাঠের মতো কোনো ব্যাপার। তাহলে তো জমে ক্ষীর। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) ছাত্র হওয়ার সুবাদে এই সব কিছু সঙ্গে করেই আমার বেড়ে ওঠা। বিকেএসপি পাঠ চুকিয়ে সবুজের কারখানা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেষ করা স্নাতকোত্তর। সব মিলিয়ে ফুটবলের পাশাপাশি বড় আকাশ আর সবুজের সঙ্গেই গলাগলি ধরে আমার এগিয়ে চলা।

পেশাগত জীবনে সেই ফুটবলময় সবুজকেই পাশে চেয়েছি আমি মনপ্রাণ উজাড় করে। কাজের চাপ! না, একটু মাঠে চক্কর দিয়ে ‘ফ্রেশ’ হয়ে আসি। গেল শীতের দুপুরে দেখার সৌভাগ্য হলো আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সেলাই দিদিমণিদের সুখী মুখ। দুপুরের খাবার খেয়ে মাঠে বসে তাঁরা মন খুলে গল্প করছেন, মায়ের কাঁধে মাথা রেখে নিরাপদে বসে আছেন মেয়ে। বিশ্রাম শেষে আবার ফিরে যাচ্ছেন দেশের অর্থনীতিকে সচলের লক্ষ্যে। পত্রিকায় পাতায় পড়া সেলাই দিদি মণিদের দুঃখের গল্পের সঙ্গে এই দৃশ্য মেলানো যায় না।

মনে মনে আমি জীবনানন্দ দাশের মতো করে বলি, ‘কাঁচা বাতাবির মতো সবুজ ঘাস— তেমনি সুঘ্রাণ— হরিণেরা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে। আমারও ইচ্ছা করে এই ঘাসের ঘ্রাণ হরিৎ মদের মতো গেলাসে-গেলাসে পান করি, এই ঘাসের শরীর ছানি- চোখে চোখ ঘষি ।’

ঢাকায় বসবাস করা মানেই যেন, ইট-বালি, সুরকির মধ্যে থাকা। সুযোগ পেলে কাছের অনেক মানুষকেই বলতে শুনি, দমবন্ধ হয়ে ওঠা ঢাকা শহরটা ছাড়তে পারলেই যেন বাঁচি! আমি সৌভাগ্যবান। আমি বলি, ঢাকাই থেকে আমি ফাঁকায় বসে অফিস করি।

রাশেদুল ইসলাম, জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার ও ফর্টিস এফসি লিমিটেডের ম্যানেজার