চড়থাপ্পড়
সকাল সকাল মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাসে উঠে জানালার পাশে বসলাম। মোহাম্মদপুর থেকে এক নারী দুইটা বাচ্চা নিয়ে উঠল। আমাকে বলল, আংকেল, একটু চেপে বসেন। অগত্যা চেপে বসলাম ঠিকই কিন্তু মন থেকে নয়। চালককে শক্ত একটা ধমক দিয়ে গাড়ি থামিয়ে এই নারীকে দুই–একটা শক্ত কথা বলতে ইচ্ছা করছে এখন।
‘কী পেয়েছেন, হ্যাঁ? পুরো বাস কিনে নিয়েছেন? যেখানে–সেখানে যারে–তারে আংকেল ডাকবেন? এখনও ঠিকমতো বিয়ের হলুদ গা থেকে শুকাতেই পারলাম না। আর আপনের দুইটা বাচ্চা অলরেডি ডাউনলোড দেওয়া শেষ। তারপরও নিজেকে ইয়াং লেডি মনে করেন? না, মানা যায় না এসব। যত্রতত্র আংকেল বললে মনটা কাচের মতো ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যায়, বাঁচতে ইচ্ছা করে না। এই দুদিনের পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে এত ভুলভাল শব্দ প্রয়োগ করে কেন এত কষ্ট দেয়! না আর সহ্য করা যায় না।
সাহস হচ্ছিল না দেখে এ কথাগুলো মনে মনে বলছিলাম। বাস শাহবাগে এসে দাঁড়াল। নারী ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, আংকেল আসি?
ওনার আসি বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার মুখের হাসিটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। বাচ্চা দুইটাকে বললেন, দাদুকে সালাম দাও। বড়দের সালাম দিতে হয়।
বাচ্চা দুইটা মুখে শাহাদাত আঙুলের মাথায় কামড় দিয়ে পলকহীন মাছের মতো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সালাম দিবে কি না, হয়তো দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে।
নারীর ধমকে বাস কেঁপে উঠল। কিন্তু ওরা দুই বোন কেঁপে উঠল বলে মনে হলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে আমাকে ভালো করে দেখতে লাগল।
নারী চেঁচিয়ে উঠল, সালাম দিতে বলছি না? দাও, দাও বলছি।
আমি হাসি-হাসি মুখ করে বললাম, থাক না আন্টি, শীতের দিন কষ্ট করে সালাম দিতে হবে না।
‘হবে না মানে? অবশ্যই হবে। আর আপনি আমাকে আন্টি বললেন কী দেখে?’
‘সরি আপু। আমার ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দেন।’
‘খবরদার! আপনে আমারে আপুও বলবেন না। প্রথম প্রথম আপু বলেই সবাই ঘনিষ্ঠ হতে চায়। তারপর...!’
‘তাহলে কী ডাকব?’
‘আপনাকে কিছুই ডাকতে হবে না। চুপ করে বসে থাকেন।’
আমি চুপ করে বসে থাকার লোক নই। কথা না বলে থাকতে পারি না। দম বন্ধ হয়ে আসে। মনে হয়, এই বুঝি পেটের ভেতর কথারা কাতুকুতু দিচ্ছে। আর আমি হাসতে হাসতে এখনই দম আটকে মারা যাব।
বললাম, আপনাকে কিছু একটা তো ডাকতে হবে। কারণ, সম্বোধন ছাড়া সম্পর্ক স্থায়ী হয় না!
‘খবরদার! উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে আমাকে প্রেমে ফেলার চেষ্টা করবেন না। আমি কচি খুকি না বুঝলেন?’
মেয়ে দুইটাও তার মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বলে উঠল, আম্মু কচি খুকি না বুঝলেন?
দুইজনকে দুই চড় দিয়ে বলল, চুপ থাক, বেয়াদব মেয়েছেলে!
আমি ব্যথিত হয়ে বললাম, ইশ! এভাবে না মারলেও পারতেন!
‘আগলা দরদ দেখাবেন না কইলাম।’
নারীর কথা শেষ হতে না হতেই মেয়ে দুইটাও বলে উঠল, আগলা দরদ দেখাবেন না কইলাম।
মেয়ে দুইটা বেশ সুন্দর করে অনুকরণ করে তার মাকে বিরক্ত করছে দেখে আমার ভালো লাগল।
আমি সত্যি সত্যি দরদ দেখিয়ে বললাম, খুকি, তোমরা আমার সঙ্গে যাবে?
ওরা মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাল ঠিকই। কিন্তু আমি যখন বাস থেকে নামব, ঠিক তখন ওরা আমার সঙ্গে নেমে পড়ার প্রস্তুতি নিল। খপ করে ওদের মা ওদেরকে ধরে এলোপাথাড়ি চড়থাপ্পড় দিতে লাগল। আমি ভয়ে দ্রুত বাস থেকে নেমে পড়লাম। এখানে আর এক মিনিটও থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কখন যে আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে কে জানে।
*লেখক: শিক্ষার্থী: এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, আশুলিয়া, ঢাকা