শৈশবের টানেই ফিরে এলাম
স্মৃতির পাতায় এখনো স্পষ্ট ভেসে ওঠে সেই ছোট্ট গেটটা, মাঠটা—যেখানে কতবার গিয়েছি বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করতে। সাদা ইউনিফর্মে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে প্রতিদিনের সেই নির্ভেজাল ছুটে চলা...যেন আজও চোখের সামনে।
সেই দিনগুলো ছিল একেকটা স্বপ্নের মতো। কখন যে পেরিয়ে গেল টেরও পাইনি। সময় তার নিজের গতিতে এগিয়ে গেছে, আর আমরা ছড়িয়ে পড়েছি জীবনযুদ্ধে। বন্ধুবান্ধবদের অনেকের সঙ্গেই বহুদিন দেখা হয়নি। তবে হঠাৎ এক অভাবনীয় সুযোগ এল—সবার আবার একত্র হওয়ার।
২০২৫ সালের ২ ও ৩ এপ্রিল স্বনামধন্য মনোহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মনিরামপুর, যশোর পা দিল তার গর্বের ৫০ বছরে। সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত পুনর্মিলনী যেন আমাদের হৃদয়ের সব অনুভূতির দরজাগুলো একে একে খুলে দিল।
বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ আলোকসজ্জায় ঝলমল করছিল। বেলুন উড়িয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান। এক রঙের টি–শার্ট পরে আমরা যখন র্যালিতে হাঁটছিলাম, তখনই মনে পড়ল সেই স্কুলজীবনের দিবসগুলো—স্বাধীনতা দিবস, বই দিবস, শহিদ দিবসের র্যালিগুলোর কথা। মনে হচ্ছিল, আমরা যেন সত্যি সত্যি সময়ের সিঁড়ি বেয়ে আবার ফিরে গিয়েছি সেই কিশোর বেলায়।
র্যালি শেষে শুরু হলো একেকজনের বক্তব্য। কারও কণ্ঠে কাঁপা সুর, কারও চোখে জল, কারও মুখে প্রশান্তির হাসি—সব মিলিয়ে এক আত্মিক আবেগে ভরে উঠল আকাশ–বাতাস। কেউ বলছিল তার জীবনের সাফল্যের গল্প, কেউ বলছিল বিদ্যালয়ের অবদান। সেসব গল্প শুনে কখনো গা শিউরে উঠল, কখনো চোখের কোণে জমল অশ্রু।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বর্তমান আর প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা এক হয়ে গাইল, নাচল, আবৃত্তি করল। স্বনামধন্য শিল্পীরাও এসেছিলেন, তবে মঞ্চের আলো জ্বলছিল আমাদের সবার হাসিতে ও আনন্দে।
ছোট থেকে বড়, কচিকাঁচা থেকে বৃদ্ধ—সবাই যেন এক বয়সে ফিরে গিয়েছিলাম। বন্ধুরা মিলে হাসির ফোয়ারা, কাঁধে মাথা রেখে পুরোনো কথা, চায়ের কাপ হাতে একনাগাড়ে গল্প। এত বছর পর দেখা হলেও মনে হলো, আমরা কেউ কোথাও যাইনি, এই তো ছিলাম একসঙ্গেই।
শিক্ষকদের চোখে–মুখে যেন এক আধ্যাত্মিক তৃপ্তি। তাঁদের হাতে গড়া শিক্ষার্থীরা আজ কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ সরকারি কর্মকর্তা, কেউ বিদেশে চাকরিজীবী। কেউ আবার কৃষক, দিনমজুর—তবুও প্রত্যেকে তার নিজ নিজ জায়গায় সংগ্রামী, আত্মবিশ্বাসী ও স্বনির্ভর। আর শিক্ষকেরা ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক—মাঝেমধ্যে শাসন করলেও তাতে লুকিয়ে থাকত ভালোবাসার গভীর ছায়া।
যাঁরা আজ আর নেই, সেই প্রিয় শিক্ষকদের জন্য সবার মনে এক চাপা কষ্ট। আমরা চুপিচুপি তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করলাম। যেন তাঁরা যেখানেই থাকেন, শান্তিতে থাকেন।
এই দুই দিনের অনুষ্ঠান যেন সময়কে স্থির করে দিয়েছিল। পুরোনো সেই দিনগুলোকে টেনে এনেছিল এখনকার জীবনে। মনে হচ্ছিল, আবার যদি সেই দিনগুলো ফিরে পেতাম... আবার যদি একটা দুপুর কাটাতে পারতাম সেই ক্লাসরুমের বেঞ্চে।
মনোহরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছি, এই অনুভব বুকের ভেতর গর্ব হয়ে বাজছে। এই সুবর্ণজয়ন্তী শুধু একটা অনুষ্ঠান ছিল না, ছিল আমাদের শৈশবকে আবার ছুঁয়ে দেখার একটা সোনালি সুযোগ।
*লেখক: পিয়াসা আক্তার আম্বিয়া, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।