কনকনে রাতে জীবন
শীতের রাত। শহরের বাতাসে হিমের চাদর। রাস্তার ধারে উজ্জ্বল আলোগুলো যেন আরও বেশি করে শীতের তীব্রতা প্রকাশ করছে। ঝকঝকে রাস্তার ওপারে ফুটপাতজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু মানবপ্রাণ। শরীরে জড়ানো ছেঁড়া চট কিংবা পুরোনো ময়লা কম্বল। তাদের পাশে শুয়ে আছে কিছু কুকুর। যেন শীতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব।
এক কোণে বসে থাকা বৃদ্ধা রহিমা বেগম থরথর করে কাঁপছেন। তার পাশে তার ১০ বছরের নাতি রাসেল। ছেঁড়া সোয়েটারের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে রাসেল বলল, দাদি, এ শীত কি শেষ হবে না?
রহিমা বেগমের চোখে জল এসে যায়। এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর তাঁর কাছে নেই। তিনি রাসেলকে কাছে টেনে নেন। শীত তো একদিন যাবেই, বাঁচতে হবে রাসেল, শক্ত থাকতে হবে।
কিছু দূরে বসে থাকা দিনমজুর করিম মিয়া শুকনো পাতায় আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছেন। আগুনের ক্ষীণ আলো আর উষ্ণতা যেন কিছুক্ষণের জন্য শীতের নির্মমতাকে ভুলিয়ে দেয়। তাঁর পাশে শুয়ে আছে এক কুকুর, যেটা করিমেরই দেওয়া নাম ‘কালা’। করিম কপট হাসিতে বললেন, মানুষ আর কুকুর আমাদের একই অবস্থা। শীত কারও জন্য বেছে আসে না।
কালার দেহটা আগুনের পাশে একটু গুটিয়ে রেখেছে। করিমের দেওয়া কিছু শুকনো রুটির টুকরো খেয়ে আবার চোখ বুজেছে। রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা বিলাসবহুল গাড়িগুলো আর দামি শীতের পোশাক পরা মানুষগুলো যেন সম্পূর্ণ আলাদা এক পৃথিবীর গল্প বলে। সেখানে শীত কেবল আনন্দ। সেখানে হট চকলেট, কম্বল, আর উষ্ণ কক্ষের আরাম। কিন্তু এই ফুটপাতের মানুষদের কাছে শীত মানেই লড়াই।
রাসেলের হঠাৎ চোখে পড়ল, একটি গাড়ি থেকে নেমে আসা এক ছোট্ট মেয়ে। তার গায়ে ছিল উজ্জ্বল রঙের একটি জ্যাকেট। মেয়েটি মায়ের হাত ধরে ফুটপাতের দিকে এগিয়ে এল। কাছে এসে সে তার জ্যাকেটটা খুলে রাসেলের হাতে দিল।
এটা নাও। আমার অনেক গরম লাগছে।
রাসেল হতবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার শীতকাতর দেহে প্রথমবারের মতো উষ্ণতার ছোঁয়া লাগে। মেয়েটি হাসতে হাসতে তার মায়ের হাত ধরে গাড়িতে উঠে যায়।
রহিমা বেগম রাসেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, মানুষ এখনো আছে রে। কিছু মানুষ এখনো আছে।
রাতে শুতে যাওয়ার আগে রাসেল তার জ্যাকেটটা রহিমা বেগমের গায়ে জড়িয়ে দিল। দাদি, তুমি গায়ে দাও। আমি শক্ত আছি।
ফুটপাতজুড়ে তখনো অনেকেই ঘুমানোর চেষ্টা করছে। কুকুরগুলো একে অপরের গা ঘেঁষে শুয়ে আছে। শীত তাদের জন্য যত কঠিনই হোক, এই ফুটপাতের প্রতিটি প্রাণ একে অপরের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।
এ শীত হয়তো কাটবে। সূর্যের উষ্ণ আলো ফিরে আসবে। কিন্তু সেই পর্যন্ত, এই কনকনে রাতে ফুটপাত জুড়ে এক অসীম জীবনের গল্প লেখা হবে। এই গল্প আশা আর লড়াইয়ের। মানুষ, কুকুরের জীবনযাপনের।
*লেখক: মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন ইবনে মোস্তাফিজ, কাপ্তাই রাস্তার মাথা, চান্দগাঁও, চট্টগ্রাম
**নাগরিক সংবাদ-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]-এ