কৃষি প্রকৌশলীদের টেকনিক্যাল ক্যাডার এখন সময়ের দাবি
বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো কৃষি। এ দেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তি এবং যান্ত্রিকীকরণের গুরুত্ব অপরিসীম। যান্ত্রিকীকরণ এবং কৃষি প্রযুক্তির প্রসারে কৃষি প্রকৌশলীদের অবদান অস্বীকার করা যায় না। তবে এত বড় ভূমিকা রাখার পরও কৃষি প্রকৌশলীরা এখনো সরকারি পর্যায়ে টেকনিক্যাল ক্যাডারের আওতায় আসেননি। এই বৈষম্য দূর করা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশের কৃষি প্রযুক্তির বিকাশে এবং উৎপাদন বাড়াতে কৃষি প্রকৌশলীরা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন। স্বাধীনতার পর বরেন্দ্র উন্নয়ন প্রকল্প এবং বিএডিসির মাধ্যমে সেচব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে তাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এই দক্ষ পেশাজীবীরা এখনো সরকারি চাকরিতে টেকনিক্যাল ক্যাডারের অধিকার থেকে বঞ্চিত। এটি কেবল তাঁদের প্রতি একটি বড় বৈষম্য ন,য় বরং দেশের কৃষি খাতের উন্নয়নকেও বাধাগ্রস্ত করছে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) দেশের অন্যতম প্রধান কৃষি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৯৬১ সালে বাকৃবি প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৬৪-৬৫ শিক্ষাবর্ষে যুক্ত হয় কৃষি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি অনুষদ, যা থেকে বিএসসি কৃষি প্রকৌশল ডিগ্রি প্রদান করা শুরু হয়। সেই থেকে প্রতিবছর মেধাবী কৃষি প্রকৌশলীরা এখান থেকে স্নাতক পাস করে দেশের কৃষি খাতে অবদান রাখছেন। তবে কর্মক্ষেত্রে টেকনিক্যাল ক্যাডারের অভাবে তাঁদের অর্জিত জ্ঞান এবং দক্ষতা পুরোপুরি কাজে লাগানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। এই বৈষম্য দ্রুত দূর করতে হবে।
বর্তমান সময়ে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর ছাত্র-জনতার উদ্যোগে দেশের সব খাতে সংস্কার চলছে। বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে এবং এখন কৃষি প্রকৌশলীদের জন্য টেকনিক্যাল ক্যাডার চালু করাও সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। ২০২৪ সালের এই আন্দোলন রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন এবং সমতার লক্ষ্যে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এ–জাতীয় সংস্কারের আওতায় কৃষি প্রকৌশলীদের জন্যও টেকনিক্যাল ক্যাডার চালু করা উচিত, যেন তাঁরা তাঁদের মেধা এবং দক্ষতা দেশের সেবায় পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেন।
সরকারি পর্যায়ে কৃষি প্রকৌশলীদের স্বীকৃতি না দেওয়া কেবল ব্যক্তিগত বঞ্চনার বিষয় নয়, এটি একটি জাতীয় সম্পদ অপচয়েরও বিষয়। একদিকে রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয় করে কৃষি প্রকৌশলীদের প্রস্তুত করা হচ্ছে, অন্যদিকে তাঁদের সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না, তখন সেটি দেশের জন্য বড় ক্ষতি। টেকনিক্যাল ক্যাডার চালু করা হলে তাঁরা কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, সেচ, উৎপাদন বৃদ্ধিসহ কৃষির বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন।
কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ের সুযোগ তৈরি করেছিল। তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাকের তত্ত্বাবধানে মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার, রিপার, কম্বাইন হারভেস্টারের মতো যন্ত্রপাতি ভর্তুকি মূল্যে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তবে এত বড় প্রকল্পেও কৃষি প্রকৌশলীদের কোনো ভূমিকা রাখা হয়নি। শুধু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অল্প সময়ে অধিকাংশ যন্ত্রগুলো অকেজো হয়ে গেছে।
কৃষি প্রকৌশলীরা এই যান্ত্রিকীকরণের মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারেন। তাঁরা যন্ত্রপাতির সঠিক ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন, কৃষকদের শেখাতে পারেন কীভাবে সঠিকভাবে যন্ত্রপাতি ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। এর ফলে ফসলের উৎপাদন অনেক বেশি বাড়ানো সম্ভব হবে। কিন্তু তাঁদের এ কাজে যুক্ত না করা দেশকে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিব্যবস্থার বিকাশে বাধাগ্রস্ত করছে।
বর্তমান সময় প্রযুক্তির যুগ, আর কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের কৃষি খাতকে উন্নত করতে হলে কৃষি প্রকৌশলীদের গুরুত্ব দিতে হবে। জমি প্রস্তুত, সেচ, ফসল কাটা থেকে শুরু করে ফসল সংরক্ষণ, সব ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগ কৃষি প্রকৌশলীরা নিশ্চিত করতে পারেন।
কৃষি প্রকৌশলীদের টেকনিক্যাল ক্যাডার চালু করা ছাড়া তাঁদের মেধা ও দক্ষতার সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। টেকনিক্যাল ক্যাডার চালু করা হলে তাঁরা মাঠপর্যায়ে সরাসরি কৃষকদের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন এবং দেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুততর করতে সাহায্য করবেন। এতে কেবল কৃষি খাত নয়, পুরো অর্থনীতিই লাভবান হবে।
অতএব, দেশের সব সেক্টরে বৈষম্য দূর করার যে প্রক্রিয়া চলছে, তার ধারাবাহিকতায় কৃষি প্রকৌশলীদের জন্যও টেকনিক্যাল ক্যাডার চালু করা এখন সময়ের দাবি। কৃষি প্রকৌশলীদের সঠিক মূল্যায়ন এবং তাঁদের দক্ষতা কাজে লাগানোর মাধ্যমেই দেশের কৃষি খাতকে আধুনিক, লাভজনক এবং টেকসই করা সম্ভব।
*লেখক: তানিউল করিম জীম, শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়