নো হেলমেট, নো ফুয়েল—নো হেলমেট, নো রাইড কি যথেষ্ট

মোটরসাইকেলে দুই ছেলে ও স্ত্রীসহ চার সদস্য নিয়ে গন্তব্যে রওনা হয়েছেন এই যাত্রী। তার ওপর আবার পতেঙ্গা চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং সড়ক বিভাজকের মাঝখানে এভাবে ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন তিনি। চালকদের এমন ঝুঁকির কারণে প্রায় প্রতিদিন এ সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। বিকেল সাড়ে চারটা, খেজুরতলা এলাকা, পতেঙ্গা, চট্টগ্রাম, ১৩ মার্চ, ২০২৫ছবি: সৌরভ দাশ

প্রতিবছরের মতো এ বছর ২২ অক্টোবর ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ নবমবারের মতো পালন করা হবে। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি’ নির্ধারণ করা হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা আজ আমাদের দেশের জন্য এক নীরব মহামারি। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় চোখে পড়ে মূল্যবান প্রাণের অকালে ঝরে যাওয়ার মর্মান্তিক খবর। বিশেষ করে দ্রুততম সময়ে সংখ্যায় সম্প্রসারিত হচ্ছে মোটরযান। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা এখন শীর্ষে। পরিসংখ্যান বলছে, সড়ক দুর্ঘটনার মোট হতাহতের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি আসে এই মোটরসাইকেল খাত থেকে। এই ভয়াবহতা তখনই রোধ করা সম্ভব, যখন চালক ও আরোহীরা তাঁদের সুরক্ষার মূল দুটি হাতিয়ার—‘মানসম্মত হেলমেট’ ও ‘নিরাপদ গতি’র গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন এবং তা নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলবেন। বেপরোয়া বা নিয়ন্ত্রণহীন গতি একটি সামাজিক ব্যাধি, সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান ও সবচেয়ে মারাত্মক কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। একটি নির্দিষ্ট গতিসীমা নির্ধারিত থাকার পরও অধিকাংশ চালক, বিশেষ করে দূরপাল্লার যানবাহন ও মোটরসাইকেলের চালকেরা স্বল্পতম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়নায় তা লঙ্ঘন করেন। গাড়ি চালানোর সময় গতি সামান্য বাড়লেও সংঘর্ষের তীব্রতা জ্যামিতিক হারে বেড়ে যায়। যেমন ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার গতিতে একটি গাড়ির সংঘর্ষের কারণে যে আঘাত সৃষ্টি হয়, তা ১০০ কিলোমিটার গতিতে প্রায় চার গুণ বেশি সৃষ্টি হতে পারে। তাই দুর্ঘটনা ঘটলে চালক বা আরোহীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না।

বাংলাদেশে সড়ক ও পরিবহনের ধরন অনুযায়ী সম্প্রতি গতিসীমা নির্দেশিকা জারি করা হলেও এর যথাযথ বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের নির্দেশনা এখনো দুর্বল। আইনকে ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা ও ট্রাফিক এনফোর্সমেন্টের ঘাটতি এই বেপরোয়া গতির সংস্কৃতিকে আরও উৎসাহিত করছে। গতি নিয়ন্ত্রণে কেবল জরিমানা আরোপ করাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে গতি পর্যবেক্ষণ (যেমন স্পিড ক্যামেরা), সড়কের অবকাঠামোতে পরিবর্তন আনা (যেমন স্পিড বাম্প, ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিতকরণ ও সংশোধন) এবং সর্বাগ্রে চালকদের মনোস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আনা, যার জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। প্রতিটি চালককে বুঝতে হবে, রাস্তার প্রতিটি জীবন মূল্যবান এবং গতির সামান্য সংযমই পারে পরিবারকে শোকের সাগর থেকে রক্ষা করতে। আমরা পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই দেখতে পাব, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাতের কারণেই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার সতর্ক করেছে যে সঠিকভাবে পরিধান করা একটি মানসম্মত হেলমেট মাথায় আঘাতের ঝুঁকি প্রায় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে। অথচ আমাদের দেশে হেলমেটের ব্যবহারকে দেখা হয় পুলিশের জরিমানা এড়ানোর উপায় হিসেবে, জীবন রক্ষার উপায় হিসেবে নয়। বর্তমানে বাজারে ২০০ থেকে ৪০০ বা ৫০০ টাকায় চকচকে নিম্নমানের হেলমেট সহজলভ্য। এগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (যেমন DOT, ECE বা বিএসটিআই স্বীকৃত) মেনে তৈরি হয় না। হালকা প্লাস্টিক ও নিম্নমানের থার্মোকল দিয়ে তৈরি এসব হেলমেট সামান্য আঘাতেই ভেঙে যায়, যা সুরক্ষা না দিয়ে উল্টো বিপদ বাড়ায়। দুর্ঘটনার সময় এসব হেলমেট কেবল ভেঙে যায় না এর তীক্ষ্ণ অংশ মাথায় ঢুকে আরও গুরুতর আঘাত সৃষ্টি করতে পারে। এখানেই প্রয়োজন ‘মানসম্মত হেলমেটের’ ওপর গুরুত্ব দেওয়া। সরকার ‘নো হেলমেট, নো ফুয়েল’ বা ‘নো হেলমেট, নো রাইড’জাতীয় উদ্যোগ নিলেও যতক্ষণ না সেই হেলমেটের মান নিশ্চিত করা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এসব উদ্যোগ কার্যত অকার্যকর থেকে যাবে।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

বিএসটিআইকে তার মান নিয়ন্ত্রণপ্রক্রিয়া আরও কঠোর করতে হবে এবং মানহীন হেলমেটের উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রয় সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে উন্নত মানের হেলমেটের দাম সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরকারকে আমদানি শুল্ক কমানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে, যাতে মানুষ জীবন বাঁচাতে বেশি দামে ভালো হেলমেট কিনতে উৎসাহিত হয়। তা ছাড়া সড়কে নিরাপত্তা জোরদার করতে বাংলাদেশ ‘সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮’ প্রণয়ন করেছে। তবে এই আইনে হেলমেট পরিধানের বাধ্যবাধকতা থাকলেও হেলমেটের মান নির্ধারণের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এই দুর্বলতার সুযোগে বাজারে মানহীন পণ্যের রমরমা ব্যবসা চলছে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্লষণের ভিত্তিতে আমি মনে করি, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হলে জাতিসংঘঘোষিত ‘সেফ সিস্টেম অ্যাপ্রোচের’(Safe System Approach) আদলে একটি সমন্বিত জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা জরুরি। এই ব্যবস্থায় নিরাপদ গতি, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী ও দুর্ঘটনা-পরবর্তী চিকিৎসা—পাঁচটি মূল স্তম্ভের ওপর জোর দেওয়া হয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে (বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ, স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগ) এই পাঁচ স্তম্ভ নিয়ে কার্যকর সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। একটি একক শক্তিশালী জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ গঠন করে এই সমন্বয়হীনতা দূর করা যেতে পারে এবং সর্বশেষ কিন্তু সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ হলো, সচেতনতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধ। সড়ক দুর্ঘটনা শুধু একটি আইনি বা প্রকৌশলগত সমস্যা নয়, এটি একটি সামাজিক ও মানসিক সমস্যাও বটে।

চালক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত না জীবনের মূল্যবোধ জাগ্রত হচ্ছে, ততক্ষণ কোনো আইনই শতভাগ কার্যকর হবে না। সড়কে নিরাপত্তা বিষয়ে ব্যাপক প্রচার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও সামাজিক প্রচারমাধ্যমে নিয়মিত প্রচারণা চালানো অপরিহার্য। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে ‘গতি-বিলাসিতা’র ধারণা পরিবর্তন করে ‘নিরাপদ রাইডিংয়ের’ সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। প্রতিটি পরিবারের উচিত তাদের বাইকার সদস্যকে একটি ভালো মানের হেলমেট কিনে দেওয়া ও নিরাপদ গতিতে চলতে উৎসাহিত করা। সম্মিলিত অঙ্গীকারই হোক রক্ষাকবচ। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর যে বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটছে, তার আর্থিক ক্ষতি দেশের জিডিপির প্রায় ২.৫ শতাংশের সমান, কিন্তু এই পরিসংখ্যানের চেয়েও বড় ক্ষতি হলো পরিবার ও সমাজের অপূরণীয় মানসিক ক্ষতি। সময় এসেছে শুধু আইন প্রয়োগের ওপর নির্ভর না করে বরং আইনের ফাঁকফোকরগুলো বন্ধ করার। বিএসটিআই কর্তৃক হেলমেটের মান কঠোরভাবে তদারকি, পুলিশ কর্তৃক গতি ও মানসম্মত হেলমেটের ব্যবহারে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ এবং চালকদের নিজস্ব দায়িত্ববোধের সমন্বয়ই পারে এই নীরব মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে। মনে রাখতে হবে, মানসম্মত হেলমেট হলো মাথার জন্য জীবন রক্ষাকারী বর্ম, আর নিরাপদ গতি হলো সেই বর্মকে কার্যকর রাখার কৌশল। এই দুটিকে একসূত্রে বাঁধতে পারলেই কেবল জাতীয় জীবনের এই চরম ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। সরকার, প্রশাসন ও জনগণের সম্মিলিত অঙ্গীকারই পারে বাংলাদেশের সড়ককে নিরাপদ এবং জীবনকে সুরক্ষিত করতে।

* লেখক: মো. ইমন হোসন, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।