ভারতে যে ডাক দিচ্ছেন থালাপতি বিজয়!

থালাপতি বিজয়ছবি: টিভিকে দলের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া

ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক অভিনব দৃশ্যপট তৈরি হচ্ছে। সংসদে বিরোধী দল কংগ্রেস যেখানে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফ্যাসিবাদী বলে সমালোচনা করতে সাহস পাচ্ছে না, সেখানে দক্ষিণি সুপারস্টার থালাপতি বিজয় তাঁর রাজনৈতিক অভিষেকেই বিজেপিকে ধর্মীয় বিভাজন ও গণতন্ত্র দুর্বল করার দায়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। শাসকগোষ্ঠী বিজেপিকে আদর্শিক প্রতিপক্ষ উল্লেখ করে রীতিমতো তোপ দাগাচ্ছেন।

২০২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত তামিলাগা ভেত্রি কাজাগাম (টিভিকে) বিজয়ের রাজনৈতিক পরিচয়কে দ্রুতই জাতীয় পর্যায়ে আলোচ্য বিষয়ে পরিণত করেছে। তামিলনাড়ুর শাসক এম কে স্ট্যালিনের দ্রাবিড় মুন্নেত্র কাজাগম (ডিএমকে) কিংবা বিজেপির বাইরে বিজয় তাঁর দলকে ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছেন। এ যেন আঞ্চলিক রাজনীতির মঞ্চ থেকে জাতীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্রে এক তরুণ নেতার দৃপ্ত পদক্ষেপ।

তবে রাজনীতির অঙ্গনে বিজয়ের পথ মসৃণ নয়। গত শনিবার কারুর জেলায় তাঁর এক বিশাল জনসভা পরিণত হলো মর্মান্তিক বিপর্যয়ে। অতিরিক্ত গরম ও বিশৃঙ্খলায় পদদলিত হয়ে প্রাণ হারান ৪০ জন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ১৬ নারী ও ৬ শিশু, আহত হন শতাধিক। এই দুর্ঘটনা শুধু তামিল রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ ডেকে আনেনি, বিজয়ের রাজনৈতিক যাত্রাকেও এক অনাকাঙ্ক্ষিত ট্র্যাজেডিতে নিমজ্জিত করেছে।

দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের পরিবারকে ২০ লাখ রুপি করে ক্ষতিপূরণ এবং পাশাপাশি আহত প্রায় ১০০ জনের প্রত্যেককে ২ লাখ রুপি করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন বিজয়। দুর্ঘটনার পর বিজয় এক্সে লেখেন, ‘আমার হৃদয় ভেঙে গেছে। আমি ভাষায় বর্ণনা করা যায় না, এমন যন্ত্রণা ও শোকে কাতর। কারুরে প্রাণ হারানো আমার প্রিয় ভাইবোনদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।’

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

গণমাধ্যমগুলোর খবর থেকে জানা যাচ্ছে, কারুর ট্রাজেডিতে শোকগ্রস্ত থালাপতি বিজয় খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। অনাকাঙ্ক্ষিত এই বিয়োগান্ত ঘটনায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বিরোধী দলীয় নেতা রাহুল গান্ধিও শোক প্রকাশ করেছেন।

ভারতের সাংবিধানিক কাঠামো নিয়ে গ্রানভিল অস্টিন তাঁর ক্লাসিক গবেষণা The Indian Constitution: Cornerstone of a Nation (1966)-এ বলেন, ভারতের গণতন্ত্র বহুত্ববাদ ও অন্তর্ভুক্তির ওপর দাঁড়ানো। বিজয় যখন বিজেপিকে ধর্মীয় বিভাজনের জন্য আক্রমণ করেন, তখন তিনি এক অর্থে ভারতের সাংবিধানিক চেতনার প্রতিধ্বনি ঘটাচ্ছেন। একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠী বা গণ্ডির বাইরে এসে বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের কথাই বলছেন।

স্যামুয়েল পি হান্টিংটন Political Order in Changing Societies (1968)-তে যুক্তি দিয়েছেন যে নতুন নেতৃত্ব যখন পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানায়, তখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপর্যস্ত হয়। থালাপতি বিজয়ের উত্থান সেই ধরনের এক ‘পরিবর্তনশীল সমাজের’ সূচক, যেখানে আঞ্চলিক আবেগ জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।

আরেক দিকে, ক্রিস্টোফ জাফরেলটের India’s Silent Revolution (2003) আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ভারতীয় রাজনীতিতে বঞ্চিত ও অবহেলিত শ্রেণির প্রতিনিধিত্বই রাজনৈতিক নবজাগরণের জন্ম দিয়েছে। বিজয়ের নায়কোচিত ইমেজ ঠিক সেই দিকেই ইঙ্গিত করছে।

যদিও সমাবেশে প্রাণহানির ঘটনায় ইতিমধ্যে তামিলনাড়ু পুলিশ টিভিকের শীর্ষস্থানীয় ছয় নেতার বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত হত্যাসহ একাধিক অভিযোগ এনেছে, বিজয়ের অবস্থান এখন দ্বিমুখী সংকটে। একদিকে শোকাহত জনতার সহানুভূতি, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের তীর্যক আক্রমণ। ইতিহাস সাক্ষী, এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করেছে কিংবা অকালেই ম্লান করে দিয়েছে।

২২ জুন ১৯৭৪ সালে জন্মগ্রহণ করা জোসেফ বিজয় চন্দ্রশেখর তথা থালাপতি বিজয়ের জীবনপঞ্জি যেমন চলচ্চিত্র-রোমাঞ্চে পরিপূর্ণ, তেমনই রাজনীতির মঞ্চেও তিনি নাটকীয় আবির্ভাব ঘটিয়েছেন। ‘বিস্ট’, ‘লিও’, ‘ঘিল্লি’, ‘মের্সাল’, ‘বিগিল’-এর মতো ছবিতে তিনি ছিলেন অবহেলিত মানুষের পক্ষের নায়ক। সেই সিনেমাটিক ইমেজই এখন তাঁর রাজনীতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। দর্শক-ভক্তরা সমাবেশে তাঁকে সিনেমার ভাষায়ই দেখতে চান—এ যেন reel থেকে real-এর রূপান্তর।

অর্থনৈতিক শক্তিও তাঁকে অন্য তারকাদের থেকে আলাদা করেছে। ফরচুন ইন্ডিয়া (২০২৪) জানাচ্ছে, অগ্রিম করদাতাদের তালিকায় সুপারস্টার শাহরুখ খানের ৯২ কোটির পরেই আছেন বিজয়। তাঁর কর-অবদান ৮০ কোটি রুপি। রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ববোধের বড় প্রতীক এটি। আরেক দিকে, ‘দ্য গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’ (২০২৪) ছবির জন্য তিনি প্রায় ২০০ কোটি রুপির পারিশ্রমিক পান, যা তাঁর অর্থনৈতিক সক্ষমতার প্রতীক।

কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়—চলচ্চিত্রের ক্যারিশমা কি রাজনৈতিক মঞ্চে দীর্ঘ মেয়াদে টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট? দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক গণ–আন্দোলন যেমন বাংলাদেশের ২০২৪–এর ছাত্র আন্দোলন, ২০২২–এর শ্রীলঙ্কার গোতাবায়াবিরোধী বিক্ষোভ এবং সম্প্রতি নেপালের যুবপ্রজন্মের প্রতিবাদ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তরুণ প্রজন্ম একটি ভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি চায়। সেই ধারাবাহিকতায় বিজয় যদি সত্যিই সৎ ও বলিষ্ঠ রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে এবং নিজের দলকে প্রমাণ করতে পারেন, তবে ভারতীয় রাজনীতিতে ‘ভারত বসন্ত’-এর জোয়ার বইতে পারে।

তবে ভারতের রাজনৈতিক বাস্তবতা জটিল। বিজেপি, কংগ্রেস কিংবা ডিএমকের মতো প্রভাবশালী দলগুলো সহজে বিজয়কে মাটি পেতে দেবে না। বরং কোনো প্রতীকী গ্রেপ্তার বা রাজনৈতিক মামলাই তাঁকে ‘ব্যাকফুটে’ ঠেলে দিতে পারে। আবার ইতিহাসে এমনটাও ঘটেছে বারবার, ভূমিকা যেটাই হোক, জনতার আবেগ ক্ষমতাসীনদের দ্বারা নিপীড়িত মজলুম নেতাকে এক ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।

এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন একজন চলচ্চিত্র নায়ক, যিনি হয়তো নতুন ইতিহাস রচনা করতে চলেছেন।

থালাপতি বিজয় ছবির মতো বাস্তব রাজনীতিতেও যদি সৎ, বলিষ্ঠ ও কর্মকুশল ব্যক্তিত্বের ভূমিকা রাখতে পারেন, তবে তিনি সত্যিকারের গণনায়কে পরিণত হবেন। আর যদি তাঁর ডাকে ভারতের তরুণ প্রজন্ম রাজপথে নামে, তবে এক নতুন ‘ভারত’ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে।