পুনরাবৃত্তি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

উত্সব মুহূর্তের মধ্যে বিষাদের কালো মেঘে ছেয়ে গেছে, উল্লাস থেমে গেছে। কারও মুখে কথা নেই! সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়! তরী গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে! বিয়েবাড়ি আনন্দের পরিবর্তে কান্নার শব্দে আকাশ–বাতাস ভারী হয়ে যাচ্ছে!

বাড়ির ছোট বউ তরী। শেখবাড়ির ছোট ছেলে রাসেল শেখের সঙ্গে গত বছর বিয়ে হয়েছে তরীর। বিয়ের বয়স যে হয়েছে, তেমন নয় আবার একেবারেও অপ্রাপ্তবয়স্ক নয়। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়া রাসেল শেখের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। তারপর দুজনে লুকিয়ে বিয়ে করে। অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়ে দুই পরিবার বিয়ে মেনে নেয়! বছরখানেক আগে বেশ ধুমধাম করে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়। এক বছর হতে না হতেই এমন করুণ পরিণতি সবাইকে হতবিহ্বল করে তুলেছে!

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে মানুষ এসে শেখবাড়িতে ভিড় করছে লাশ দেখার জন্য! ফেরার পথে কেউ আফসোস করছে আবার কেউ নানা রকম কথা বলছে। রমিজ শেখ ভালো মানুষ। তাঁর বড় দুই ছেলেও অনেক ভালো, কিন্তু ছোট ছেলেটা ব্যতিক্রম, বেশি আদর পেয়ে কিছুটা বখে গেছে। অনার্সে ভর্তির পর বাবার কাছে আবদার করে বাইক ও বড় ভাইয়ের কাছ থেকে আইফোন বাগিয়ে নেয়। এরপর নায়ক নায়ক ভাব নিয়ে মফস্‌সলের কলেজে যায়। বাইক আর আইফোনের ইমেজ কাজে লাগিয়ে মেয়েদের সঙ্গে ফ্লাট করে, এখানে–সেখানে ঘুরে বেড়ায়। এভাবেই সুন্দরী তরীকে পটিয়ে বিয়ে করে।

আয়রোজগার না থাকলে ভালোবাসা বালির বাঁধের মতো ভেসে যায়। নববিবাহিত রাসেল–তরী দম্পতি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পায়। পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েকে পরিবার যেটুকু সাপোর্ট দেয়, তার চার আনাও বিবাহিতদের দেয় না। এসব নিয়ে তাদের মধ্যে প্রায়ই মনোমালিন্য হয়, ঝগড়া হয়। রাসেল পড়াশোনার পাশাপাশি আয়রোজগার করার জন্য এটা–সেটা করতে চায়, কিন্তু এগোতে পারে না। সামনে ঈদ, ওদের কপালে চিন্তার ভাঁজ!

‘নাগরিক সংবাদ’–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]

কয়েক দিন ধরে তরীর মাথায় এক বুদ্ধি আসে, রোজার সময় কলেজ ছুটি থাকবে। যদি এই ছুটির সময় রাসেল ঢাকায় গিয়ে কাজ করে, তাহলে ঈদের খরচ কিছুটা মেটানো যাবে, ছোটদের সালামি দেওয়া যাবে। তা ছাড়া টাকার জন্য মুরব্বিদের ওপর নির্ভর করতে হবে না। সে রাসেলকে পরামর্শ দেয়, রোজার আগে ঢাকায় গিয়ে মাস দুই কাজ করার জন্য। তরীর প্রস্তাবে রাজি হয় রাসেল। রোজার আগে সে যমুনা ফিউচার পার্কের একটা মাঝারি মানের দোকানে সেলসম্যানের কাজ নেয়। তারপর বাড়ি ছেড়ে চলে আসে ঢাকায়। তরী ভাবে, দেড় মাস কাজ করলে ঈদটা ভালোই কাটবে। আগামী বছর রাসেলের অনার্স শেষ হলে কিছু একটা করতে পারবে, তখন সুখ আর সুখ! শরীর খারাপের মধ্যে একধরনের আত্মতৃপ্তি অনুভব করে সে।

কিন্তু ঘটনা কখনোই ভাবনার মতো হয় না! তরীর ক্ষেত্রেও হয়নি! রাসেল ঢাকায় গিয়ে কাজ করেছে ঠিকই, কিন্তু কোনো টাকাপয়সা নিয়ে ফেরেনি! প্রায় খালি হাতেই ঈদের আগের দিন এসেছে, এমনকি তরীর জন্য একটা পোশাক পর্যন্ত কেনেনি। অজুহাত হিসেবে বলেছে, বেতন ঈদের পরে দেবে। দীর্ঘ দেড় মাস পরে বাড়িতে এসে তরীর প্রতি তেমন আগ্রহ দেখায় না সে।

ঈদে পরদিন রাসেলের চাচাতো বোনের গায়েহলুদ, তার পরদিন বিয়ে! সে উপলক্ষে শেখবাড়িতে সাজসজ্জার কাজ চলছে ঈদের দুই দিন আগে থেকেই। গায়েহলুদের অনুষ্ঠান বেশ জমকালো হবে এবার। তরী কত কিছু কল্পনা করে রেখেছিল, কিন্তু সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে। এতটা খারাপ ঈদ তার জীবনে কখনো আসেনি। মা–বাবার এক মাত্র মেয়ে সে, যখন যা চেয়েছে, তা সঙ্গে সঙ্গে পেয়েছে অথচ এবারের ঈদে তার হাতরাঙানো মেহেদি ছাড়া কিছু কেনা হয়নি। যদিও শ্বশুরবাড়ি, বাবার বাড়ি থেকে উপহার পেয়েছে, কিন্তু নিজের মতো কিছু নেই। চাপা কান্নায় চাঁদরাত কাটিয়ে দেয় সে!

ঈদের দিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও গোসল করে শ্বশুরের দেওয়া শাড়ি পরেছে তরী। ইচ্ছা ছিল রাসেলের বাইকে চড়ে ঈদের দিন বিকেলে বাবার বাড়িতে যাবে, কিন্তু রাসেলের সময় হয় না। সে ব্যস্ত গায়েহলুদের স্টেজ সাজানোর কাজে। তরী নিজেও সময় পায় না। একে তো ঈদ, তারপর সমবয়সী ননদের বিয়ে! পাওয়া না–পাওয়ার হিসাব আড়াল করে কনের সঙ্গে খুনসুটি করে কাটিয়ে দেয় ঈদের বিকেল, সন্ধ্যা ও রাত।

পরদিন সকালটা কাটে আত্মীয়স্বজনদের আপ্যায়নে। দুপুরে ননদকে সঙ্গে নিয়ে পারলারে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। হলুদের মতো করে সে নিজেও পারলার থেকে সেজে আসবে! প্রেম করার সময় রাসেল প্রায়ই বলত, দোহারা লিকলিকে গড়নের তরীকে সাজলে পরির মতো দেখায়। এ কথা মনে করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ফিক করে হেসে দেয় সে। ছোট্ট রুমের মধ্যে সে হাসি প্রতিধ্বনিত হয়। এরপর অবচেতন মনে চারদিকে খেয়াল করে, কেউ দেখে ফেলল না তো!

এমন সময় বিছানায় রাখা রাসেলের ফোন কয়েকবার বেজে ওঠে। তারপর মেসেঞ্জারে অনর্গল মেসেজ আসতে থাকে। তরী সাধারণত রাসেলের ফোন ধরে না, কিন্তু অনেকবার ফোন আসতেছে, মেসেজ আসতেছে। সে মনে করে, পারলার থেকে ফোন আসতেছে, কারণ রাসেলের ক্লাসমেট পারলারের মালিক। গতকাল বলেছে, ঈদের পরদিন অনেক ভিড় থাকবে, তাই ঠিক সময়ে আসতে হবে। ফোন ধরতেই অন্য পাশ থেকে ফোন কেটে দেয়! মেসেঞ্জার ওপেন করে দেখে, রাসেলের সঙ্গে এক মেয়ের অন্তরঙ্গ ছবি! একে একে ইনবক্সের সম্প্রতি সব মেসেজ পড়ে সে বুঝতে পারে, রাসেল ইশিতা নামের এক মেয়েকে বিয়ে করেছে। মুহূর্তের মধ্যে ফড়িংয়ের মতো দোল খাওয়া মেয়েটা জমে বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে যায়!

এদিকে হবু বউ রেডি হয়ে তরীর রুমে এসে তরীকে দেখতে পায় না। এঘর–ওঘর করেও দেখা মেলে না। তারপর ডাকাডাকি করেও তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। রাসেল রুমে এসে দ্রুত ওর ফোন হাতে নেয়। ফোন আনলক করেই বুঝতে পারে, তরী সব জেনে গেছে। তারপর রাসেল তরীর নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে, কিন্তু কোনো খোঁজ নেই। এদিকে দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে, আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করেছে, কিন্তু কনেকে নিয়ে কেউ পারলারে যাচ্ছে না। বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তরীর হদিস মিলছে না!

ঘণ্টাখানেক পরে রাসেলের মেজ চাচার বাড়ি থেকে গগনবিদারী চিত্কারের শব্দ আসে। এই বাড়ি রাসেলদের বাড়ি থেকে কয়েক শ গজ দূরে। সবাই ছুটে যায় ওই বাড়িতে। গিয়ে দেখে, একটা জীর্ণ ফ্যানের সঙ্গে বীভৎসভাবে ঝুলে আছে তরী! লোকজন দ্রুত ধরাধরি করে তাকে নামিয়ে আনে, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।

উষার আলো ফোটার আগেই তরী নামের চঞ্চল বধূটি গোধূলির রক্তিম আভায় হারিয়ে যায় মহাকালের অতল গহ্বরে। ওর দেহটা বারান্দায় পাটির ওপরে শুয়ে রাখা হয়েছে। চাদরে ঢাকা দেহের তুলনায় তলপেটটা সামান্য উঁচু হয়ে আছে। বাড়িতে আসা লোকজন বলাবলি করছে, পৃথিবীর আলো দেখার আগেই চার মাসের আরেকটা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ঠিক এক যুগ আগে এই বাড়ির এই ঘরে আরেকটা মেয়ে গলায় দড়ি দেয়। সে মেয়েও চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল!

*রূপক, মিরপুর, ঢাকা