আমাদের বাতিঘর ইউসুফ স্যার

ইউসুফ আলী স্যারছবি: সংগৃহীত

আমাদের বাতিঘর ইউসুফ আলী স্যার। এ পৃথিবীর চক্রবাক থেকে বিদায় নেন ২০১৮ সালের ১৭ আগস্ট। ইউসুফ স্যার চলে গেলেন অন্য ভুবনে কিন্তু এ ভুবনে রেখে যাওয়া সৃষ্টির মগজে, মননে, স্মরণে তাঁর ব্যাখ্যাতীত বিচরণ হচ্ছে; হবে। পেশাগতভাবে অনেকেই শিক্ষক হয়। তবে কেউ কেউ শিক্ষক হন। কেউ কেউয়ের মধ্যে তিনি একজন।

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের ভাষায়, ‘জীবন ছোট নয়, আমাদের সুখের মুহূর্তগুলো ছোট। তা ছাড়া জীবন ছোট মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে স্মৃতির অভাব। আমরা কখনো বর্তমানে থাকি না—হয় থাকি ভবিষ্যতে, নাহয় অতীতে। আমরা পাওয়াকে ভুলে যাই বলেই মনে হয় কিছুই পাই নাই। বর্তমান নিঃসন্দেহে অতীত আর ভবিষ্যতের একটা জীবিত ফাইল। থাকবে না কিছুই, সবাই চলে যাবে। কিন্তু ওই যে আশ্চর্য মুহূর্তগুলো পাওয়া গেল, সেগুলোই জীবন। আমাদের সহস্র ক্রোশ দৌড়ানোর একটা মাইলফলক।’

আমাদের জীবন ফাইলকে আলোকোজ্জ্বল করতে যাদের নিরন্তর ধ্যানের রাজ্য; তাঁরাই হচ্ছেন শিক্ষক। ইউসুফ আলী স্যার ছিলেন সেই ছুটে চলা ধ্যানীদের মধ্যে অসাধারণ একজন। শতবর্ষী বোরহানউদ্দিন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের (বর্তমানে বোরহানউদ্দিন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়) গণিত পড়াতেন। বিজ্ঞান বিষয়েও ছিল তাঁর পাণ্ডিত্য। মানুষটার আপাদমস্তক ধমনি, শিরা-উপশিরার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে বহমান ছিল আলোকিত মানুষ গড়ার নিখাদ তাগিদ।

স্যার গণিতের ক্লাস নিতেন অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত। তাঁর বিষয়ে কেউ ফেল করতে পারবে না—এ লক্ষ্য নিয়ে তিনি পড়াতেন। যারা একটু ভালো, তাদের তিনি আলাদা করতেন। পাশাপাশি যারা দুর্বল ছিল, তাদের ঘষামাজার জন্য তাঁর আলাদা কেয়ার ছিল। এ জন্য স্কুলসংলগ্ন তাঁর বাসার দরজা সব সময় সবার জন্য ছিল উন্মুক্ত। এটাকে প্রচলিত অর্থে প্রাইভেট পড়া বলা যাবে না।

তাঁর কাছে বাসায় দিনের পর দিন পড়তে যায়নি—এমন কোনো ছাত্র আছে কি না আমার জানা নেই। তবে সংখ্যাটা যে শূন্য হবে এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ। এ জন্য স্যারের কোনো নির্দিষ্ট চাহিদা ছিল না। ছিল না নির্দিষ্ট দিনক্ষণ। চল্লিশোর্ধ্ব অনেককে বলতে শুনেছি, বাড়ি থেকে পাঁচ শ এনে স্যারকে দিতাম দেড় শ। তাতে তাঁর কোনো প্রশ্ন ছিল না। কে কত দিয়েছে বা দেয়নি—এটা তাঁর মাথায়ই ছিল না। বরং উল্টা বলতেন, ‘কাল থেকে পড়া মিস দিলে কিন্তু তোর বাবাকে জানাব।’ খুব সম্ভবত স্কুল টাইমের বাইরে বিনা পয়সায় এত ছাত্র আর কেউ পড়ায়নি। অবশ্য অভিভাবকের কাছ থেকে টাকা ঠিকই আনা হতো, স্যার পর্যন্ত পৌঁছত না।

সুন্দর মুহূর্তগুলো আমরা মনে রাখি না, ভুলে যাই। কে ১০০ দিন রসগোল্লা খাইয়েছিল, সেটা আমরা মনে রাখি না, কিন্তু কে একদিন কান মুচড়ে দিয়েছিল, তা মনে রেখে দিয়েছি। এমনই হয়।

প্রায় ৩৫ বছর আগে তোলা ছবিতে সহকর্মীদের সঙ্গে ইউসুফ স্যার (বাঁ থেকে ষষ্ঠ)
ছবি: লেখকের পাঠানো

স্যারের বাসা ছিল নিরিবিলি। চারপাশে নানা ফলের গাছ। আমরা, মানে ’৯২ ব্যাচের আমি, আকবর, রুমু, মুজিব, মাহাবুব, ফয়সাল, সাইফুল লিটন, মনির স্যারের যে পরিমাণ ফল, ডাব, কন্ডাওয়ালা (নারকেলের চারার ভেতরের শাস) নারকেল লুকিয়ে খেয়ে ফেলেছি; ওগুলোর হিসাব দিয়েই কূল পাব না। বাপের যেমন শান্তশিষ্ট ছেলে থাকে, দুষ্ট ছেলেও থাকে। আমরা একটু বেশিই দুষ্ট ছিলাম। স্যার সব বুঝতেন। তিনি যে বুঝেছেন এটাও ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিতেন। বিষয়টা এমন যে আমি বুঝেছি কিন্তু অঙ্ক বই আর খাতা নিয়ে আসতে হবে। কখনো বাসার সামনের সুপারিবাগানের ভিতর হোগলা বিছিয়ে কখনো ঘরের মধ্যে গাদাগাদি করে ক্লান্তিহীন পাঠদান। কারও শেষ; কারও শুরু। সংখ্যা কিন্তু কমত না। অবাক লাগে মানুষের এত ধৈর্য হয় কীভাবে! বছর নয়েক আগের কথা। স্যারের তখন স্মৃতিশক্তি ভালোই। বেলা দুইটা। স্যার ঈদগাহ মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে বাসার দিকে যাচ্ছেন। পাশে তাঁর ছোট ছেলে সুমন। পিছু নিয়ে বাসা পর্যন্ত গেলাম। স্যার বসলেন। আমি তাঁর পায়ের কাছে বসে পড়লাম।

কি রে উঠে বস।

না স্যার ঠিক আছে।

আস্তে বললাম, স্যার, ছাত্রাবাসে থাকার সময় আপনার দুষ্ট পোলারা অনেক অন্যায়-অত্যাচার করেছে। আপনার ফলমূল অনেক কিছু খেয়ে ফেলেছে। আপনি আমার মাথায় হাত রেখে বলেন, মাফ করেছেন। নাহলে আমি পা ছাড়ছি না। স্যার মাথায় হাত রেখে বললেন, দূর বোকা, ওগুলো তো খাওয়ার জন্যই! এবার ওঠ।

মনে পড়ে, ফজরের ওয়াক্তে স্যার রুমের দরজায় কড়া নাড়ত প্রতিদিন। হাঁক ছাড়তেন, ‘ওঠ, নামাজের সময় হয়েছে!’ আমরা না শুনি না শুনি করে শুয়ে থাকতাম। স্কুল টাইমে লেইজারের সময় বেত ঘুরিয়ে ভবনের এ মাথা থেকে শেষ মাথায় টহল দিয়ে ছাত্রদের মসজিদে ঢোকাতেন। খুব সম্ভবত এটা বড় মাদ্রাসায় দেখা যায় না।

আমার প্রয়াত বাবা মোফাজ্জল হোসেন ছিলেন স্যারের কলিগ। বাবা ছিলে ইংরেজির শিক্ষক। স্যার আর আমার বাবা প্রায় একই প্রকৃতির। একসঙ্গে দুজনে সোনালি সময়গুলো একসঙ্গে পার করেছেন। কেউ কারও বিরুদ্ধে একটা মন্দ কথা বলতে শুনিনি।

ওপারে অ-নে-ক ভালো থাকুন স্যার।

*লেখক: শিক্ষক