হেলালের স্বপ্ন বাস্তবায়নের গল্প

আল হেলাল নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন ছোট ওয়ার্কশপছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা শুধু আইডিয়া নয়, আইডিয়া বাস্তবায়নেও পারদর্শী। মো. আল হেলাল এর জ্বলন্ত প্রমাণ। অফিশিয়াল কাজে বহুবার চীন সফরের সুযোগ হয়েছে। সেখানে গিয়ে শুনেছি এবং দেখেছি একটি কৃষিপ্রবণ গ্রাম এলাকা কীভাবে সেনজেন ইনোভেটিভ শিল্প শহরে রূপ লাভ করেছে। চীনের এক ছোট্ট শহরে একসময় ছিলেন কৃষক আর হস্তশিল্পী। তাঁরা কখনো কল্পনাও করেননি যে তাঁদের হাতের পণ্য একদিন নিউইয়র্ক বা দুবাইতে যাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে বাড়িতে বাড়িতে ছোট ছোট ওয়ার্কশপ তৈরি হলো। একেকজন তাঁদের নিজস্ব পণ্য তৈরি করল এবং কয়েক বছরের মধ্যে সেই শহরটাই হয়ে গেল এক্সপোর্ট হাব। আজ চীনের ঘরে ঘরে এক্সপোর্টার। তাঁরা দেশের জন্য ডলার আনেন আর বদলে নিচ্ছেন নিজেদেরই জীবন।

প্রশ্ন হলো তাহলে আমাদের উদ্যোক্তারা কেন পারবেন না? আমাদের উদ্যোক্তারাও পারেন। আমাদের তরুণেরা অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। কুষ্টিয়ার আল হেলাল এর প্রমাণ। অফিসের কাজে সম্প্রতি কুষ্টিয়া গিয়েছিলাম। সঙ্গে ছিলেন গ্রামীণ কল্যাণের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম মইনুদ্দিন চৌধুরী আর গ্রামীণ কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরুল ইসলাম খান। কাজ শেষে ফেরার পথে গ্রামীণ ট্রাস্টের নবীন উদ্যোক্তা আল হেলালের আল হেলাল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ ভিজিট করলাম। আল হেলাল গ্রামীণ ট্রাস্টের একজন উপকারভোগী। উদ্যোক্তা হিসেবে তাঁর সফলতা ও ইনোভেশনের কাহিনি অনেক শুনেছি। ভাবলাম স্বচক্ষে দেখে যাই তাঁর লড়াই ও উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার কাহিনি। তাঁর কাহিনি যে কাউকে অবাক করে দেবে, অন্যদের দেবে অনুপ্রেরণা।

আল হেলালের উদ্যোক্তা হওয়ার কাহিনি প্রমাণ করে মানুষের মনের মধ্যে জ্বলন্ত আকাঙ্ক্ষা থাকলে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয় না। তবে তাঁর সফলতার দিনগুলো ছিল কঠোর সংগ্রামের ও কষ্টার্জিত। নানামুখী প্রতিকূলতা জয় করতে হয়েছে তাঁকে।

১৯৯৮ সালে পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে সাপ্তাহিক ২০ টাকা মজুরিতে কুষ্টিয়া শহরের একটি ওয়ার্কশপে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এক বছর ২০ টাকা মজুরিতে কাজ করার পর একটি ওয়ার্কশপ তাঁর কাজের দক্ষতা দেখে তাঁকে সাপ্তাহিক ৫০ টাকা মজুরি অফার করে। তিনি তখন ৫০ টাকা মজুরিতে কাজ শুরু করেন। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর ৯ হাজার টাকা মজুরিতে কাজ করেছেন। কাজ শিখতে শিখতে তাঁর মনে হলো তিনি একদিন নিজে ওয়ার্কশপ দেবেন। সেই লক্ষ্যে কষ্ট করে টাকা জমানো শুরু করেন। দীর্ঘদিনের জমানো টাকা দিয়ে ২০১৪ সালে ৬ ফিট সাইজের একটি লেদ মেশিন কিনে ছোট্ট একটি দোকান ভাড়া নিয়ে যাত্রা শুরু করল আল হেলাল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। শুরুতে তিনি একাই কাজ করতেন। পরে তাঁকে সাহায্য করার জন্য একজন সাহায্যকারী নিয়োগ দেন। পুরোদমে কাজ শুরু করায় ওই সময় মাসিক খরচ বাদে নিট লাভ হতো ১২ হাজার টাকা। তাঁর কাজের সুখ্যাতি বৃদ্ধি পাওয়ায় কাজের পরিধি দিন দিন বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় তাঁর আরও মেশিন কেনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কিন্তু কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাঁকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেনি। সে সময় কুষ্টিয়ায় গ্রামীণ কল্যাণের নবীন পুঁজি বিনিয়োগ কর্মসূচি চালু হয়, যা বর্তমানে জিটি-জিকে নবীন পুঁজি বিনিয়োগ কর্মসূচি নামে তার কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ কর্মসূচির লক্ষ্য হলো বেকারত্ব থেকে তরুণদের উদ্যোক্তায় পরিণত করা। যাঁরা পুঁজির অভাবে ব্যবসা বড় করতে পারছেন না, তাঁদের সহায়তা করা এবং অন্যদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এ সময় আল হেলাল জিটি-জিকে নবীন পুঁজি বিনিয়োগ কর্মসূচির কথা শুনে কুষ্টিয়ায় কুষ্টিয়া ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

আল হেলাল নিজে তাঁর প্রকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। উপস্থিত অন্যরা তাঁর উপস্থাপিত প্রকল্প প্রস্তাবের ওপর প্রশ্ন করেন এবং আল হেলাল তাঁদের সব প্রশ্নের উত্তর দেন। একই ল্যাবে প্রস্তাবটি নিয়ে গ্রুপভিত্তিক আলোচনা ও গ্রুপের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রকল্প প্রস্তাবটি অনুমোদন করা হয়। পরে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে আল হেলাল তাঁর প্রকল্পের জন্য ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ গ্রহণ করেন। বিনিয়োগের টাকা দিয়ে তিনি একটি লেদ মেশিন ক্রয় করেন এবং দুজন কর্মী নিয়োগ দিয়ে পুর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করেন। নিয়মানুযায়ী বিনিয়োগের টাকা পরিশোধ করে চতুর্থ দফায় ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ গ্রহণ করে বড় পরিসরে সুন্দরভাবে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। বর্তমানে তাঁর ওয়ার্কশপে চারটি বড় লেদ মেশিন, ওয়েল্ডিং মেশিন, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও আটজন কর্মী কাজ করছেন। সব খরচ বাদ দিয়ে তাঁর এখন মাসিক নিট লাভ হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে তিনি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহায়তা নিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করছেন। তাঁর তৈরি গাছ থেকে বাদাম ছাড়ানোর মেশিন নিয়ে সাম্প্রতিক তিনি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আয়োজিত মেলায় অংশ নিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন।

আল হেলাল
ছবি: সংগৃহীত

আল হেলালের অন্যের দোকান, সাপ্তাহিক ২০ টাকা মজুরিতে চাকরি, কাজ শেখা, সার্বক্ষণিক আইডিয়া নিয়ে ভাবনা, নতুন নতুন কৃষি যন্ত্রপাতি আবিষ্কার, উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের আকাঙ্ক্ষা তাঁকে একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছে। নানা রকম কৃষি যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের সঙ্গে দেখলাম পেঁয়াজ সংরক্ষণের এক চমৎকার যন্ত্র তিনি তৈরি করেছেন। কৃষি বিভাগের সহায়তায় এ পর্যন্ত কুষ্টিয়া ও মেহেরপুর জেলায় ২০০টি যন্ত্র তৈরি করে সরবরাহ করেছেন। পাবনা, ফরিদপুর ও নাটোরে আরও ১৫০টি যন্ত্র সরবরাহের প্রক্রিয়া চলছে। কৃষি ও পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সরকারের অন্যান্য দপ্তরের সহায়তা পেলে তিনি পেঁয়াজ সংরক্ষণের হাজার হাজার মেশিন তৈরি করতে সক্ষম বলে আমাদের জানিয়েছেন। একটি যন্ত্র দিয়ে ৪০০ মণ পেঁয়াজ সারা বছর সংরক্ষণ করা যাবে। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য আছে স্বনিয়ন্ত্রিত সেন্সর–ব্যবস্থা। অথচ পেঁয়াজ সংরক্ষণের অভাবে আমাদের দেশের কৃষকেরা মৌসুমে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হন। মেশিনটির দাম মাত্র ২৫ হাজার টাকা। তবে তা চালাতে বিদ্যুৎ–সংযোগ জরুরি। আবার দেখলাম পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি করেছেন পেঁয়াজ কাটার মেশিন, যা পাইলটিং করছেন। চাকরি চাইব না, চাকরি দেব—এই দর্শন ধারণ করেই আল হেলাল গ্রামীণ ট্রাস্টের পুঁজি বিনিয়োগ কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে একটি লেদ মেশিন ক্রয় করে তাঁর ব্যবসার যাত্রা শুরু করেন। বর্তমানে তাঁর ওয়ার্কশপে আটজন কর্মী কাজ করছেন।

এ ছাড়া নিজ বাড়িতে ১৫ জন নারী কর্মী দিয়ে কাপড়ে সুই-সুতা দিয়ে ছবি আকার কাজ, পুঁতি দিয়ে বিভিন্ন ব্যাগ ও শাড়ি এবং থ্রিপিসে কাজ করান।

তাঁর কাজ ও যন্ত্রপাতি তৈরির দক্ষতা দেখে নিউজিল্যান্ড, তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা অনেক প্রতিনিধিদল তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করেছে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন ক্যালটন কার ওয়ার্কশপ পরিদর্শন করে তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন। তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বহু ক্রেস্ট ও সনদ পেয়েছেন, যা তাঁর ওয়ার্কশপ ভিজিট করে দেখা যায়।

আল হেলালের এ সফলতা প্রমাণ করে বাংলাদেশেও একই সম্ভাবনা আছে। আমাদের উদ্যোক্তারা শুধু আইডিয়া নয়, আইডিয়া বাস্তবায়নেও সমান পারদর্শী। ছোট ছোট উদ্যোগ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছানো সম্ভব, তবে এর জন্য প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। আল হেলালের মতো উদ্যোক্তাদের সহনীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন ও নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সার্বিক সহায়তা দিতে পারলে এ দেশে একটি উদ্যোক্তাবিপ্লব গড়ে তোলা সম্ভব, যা দেশের অর্থনীতিকে নিয়ে যাবে ভিন্নমাত্রায়।

আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে আছে উদ্যম, আইডিয়া, আছে নতুনত্ব। তবে যদি ছোট ছোট উদ্যোগ থেকে শুরু করে, সাহস করে বড় কিছু তৈরি করে বাজারে নিয়ে আসে, তাহলে সব সীমাবদ্ধতা দূর করা সম্ভব। এ জন্য আমি মনে করি, আমাদের দেশে এখনই তৈরি করা দরকার একটি নবীন উদ্যোক্তা ব্যাংক। আশা করি, সরকার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করবে।

*আবদুল হাই খান: এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান, গ্রামীণ ট্রাস্ট