বাবার কথা মনে পড়ে
আজ আমার বাবার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২২ সালের এই দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। আজকে বাবার কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। তাঁকে নিয়ে অনেক কিছুই লিখতে ইচ্ছা করছে। আসলে লেখার মধ্য দিয়ে কখনো কোনো ব্যক্তিকে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রকাশ করা যায় না। আমার বাবা খোন্দকার তোজাম্মেল হক। তিনি দীর্ঘদিন সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার নিমগাছি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ ৮২ বছরের ঘটনাবহুল তাঁর জীবন। তিনি ব্রিটিশ, পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশ শাসনামল অতিবাহিত করেছেন। তিনি ২০০১ সালে নিয়মিত কর্মজীবন থেকে অবসরে যান। তাঁর কর্মজীবন ছিল যেমন বর্ণিল, তেমনই বৈচিত্র্যপূর্ণ।
খুব সহজ–সরল জীবনযাপনকারী বাবা পেশায় শিক্ষক ছিলেন। তিনি ক্লাসে ইংরেজি ও বাংলা ব্যাকরণ পড়াতেন। শিক্ষানুরাগী সমাজ সচেতন মানুষটি সবকিছু রুটিন অনুযায়ী করতেন। কখনো এর ব্যত্যয় ঘটত না। সময় সম্পর্কে তিনি খুব সচেতন ছিলেন। নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ ছিল তাঁর জীবনের অনন্য দিক। পেশাগত জীবনে তিনি দক্ষ ও অধিক মনোযোগী ছিলেন। শিক্ষাদানই ছিল তাঁর প্রধান ব্রত। কর্মস্থলের বাইরে তিনি নিজ বাড়িতে বিনা বেতনে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দান করতেন। এ কাজেই ছিল তাঁর আনন্দ।
তিনি সমাজের আর দশজন মানুষের মতো খুব বেশি ধর্মীয় অনুভূতিপ্রবণ ছিলেন না। ‘আমি ঠিক প্র্যাকটিসিং ধার্মিক নই। আমি ধর্ম বলতে বুঝি, যতটা পারা যায়, জনগণের উপকার করা। ভালো কিছু করা। মানুষের উপকার করছি। এটাই আমার কাছে ধর্ম’ (প্রফেসর আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ)। বাবা ঠিক এভাবেই ধর্মকে ব্যাখ্যা করতেন। নিরহংকার ও বিনয়ী প্রকৃতির মানুষটি সব শ্রেণির মানুষকেই সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতেন। বিশেষ করে তাঁর শিক্ষকশ্রেণিকে বেশি মর্যাদা দিতেন। নরম প্রকৃতির মানুষ হওয়ায় নিকট আত্মীয় ছাড়াও গ্রামের অনেকে তাঁর কাছে অর্থ ধার চাইলে তাঁকে নিরাশ করতে পারতেন না। তবে তিনি ধার দেওয়া টাকা ফেরতের আশা কোনোদিন করেননি। অনেকেই তাঁর কাছ থেকে এ সুবিধা পেতেন। ২০০১ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি নামাজ–রোজাসহ নিয়মিত ধর্মবিষয়ক গ্রন্থ অধ্যয়ন করতেন এবং লব্ধজ্ঞান পরিবারের সদস্য ও পাড়া–প্রতিবেশীদের সঙ্গে শেয়ার করতেন।
অসম্ভব ধৈর্যশীল ও চাপা স্বভাবের মানুষটি সব সময় ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে চলতেন। সন্তানদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ ভালোবাসা; কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ ছিল খুবই কম। তিনি সব শ্রেণির মানুষকে ভালবাসতেন, তবে শিক্ষিত মানুষ বেশি পছন্দ করতেন। দিনের প্রায় পুরোটা সময় তিনি কর্মস্থলে কাটাতেন। পারিবারিক বিষয়ে খোঁজখবর রাখার সুযোগ তাঁর জীবনে খুব কমই ঘটেছে। বাড়িতে অধিকাংশ সময় কাটত তাঁর রেডিও শুনে, টেলিভিশন দেখে, পত্রিকা ও বই পড়ে। তাঁর আগ্রহের বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ইতিহাস ও রাজনীতি।
তিনি সব সময় নিজেকে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে পছন্দ করতেন। অফিস ও নিজের ঘর সব সময় নিজেই পরিপাটি রাখতেন। তাঁর ব্যবহৃত কোনো জিনিসে কেউ হাত দিলে তিনি খুব বিরক্ত হতেন। ছোট চেকের হালকা রঙের লুঙ্গি ও সাদা টেট্রন (৩৫/৬৫) কাপড়ের হাফ/ফুলশার্ট ছিল তাঁর প্রিয় পোশাক। রঙিন কাপড় তিনি পছন্দ করতেন না, আমাদেরও পরতে নিরুৎসাহিত করতেন।
মিতব্যয়িতা ছিল তাঁর জীবনের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কখনো খরচ করেননি। বাহুল্যতা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। নতুন কোনো পোশাক উপহার দিলে তিনি সহজে পরতে চাইতেন না। বলতেন ‘আমার তো অনেক পোশাক আছে। আবার কেন, এত কিছু কেনার দরকার ছিল।’
বাবা নিমগাছি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা আহম্মদ আলী সরকার সাহেবের প্রিয়ভাজন ছিলেন। তিনি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে নানা কাজে সহযোগিতা করেছেন। স্কুলের প্রয়োজনে পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অর্থ ও ধান সংগ্রহের কাজে আহম্মদ আলী সরকারকে সাহায্য করতেন। বিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর দীর্ঘ পথচলা। অর্থাৎ বিদ্যালয়ে ১৯৮০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত একটানা ২১ বছর তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর সময়কালে তিনি বিদ্যালয়ের নানা প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সক্ষম হন। ওই সময়েই বিদ্যালয়টি সরকারি সাধারণ উন্নয়ন পরিকল্পনাভুক্ত হয়ে দোতলা ভবন নির্মাণ, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ক্রয়, আসবাব, পাঠাগারের বই ক্রয় এবং খেলার মাঠের প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়। তা ছাড়া সরকারিভাবে প্রচুর অর্থ বরাদ্দ মঞ্জুর হয়। তিনি বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটি এবং স্থানীয় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ওই টাকা যথাযথভাবে ব্যয় করেন।
সমাজের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনা তিনি লিখে রাখতেন, এটা আমরা জানতাম। তবে তাঁর মৃত্যুর পর আবিস্কার করি, তিনি নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন। কিন্তু কাউকে সেটা দেখাতেন না। সযত্নে আগলে রাখতেন। সেই ডায়েরিতে সমকালীন বিষয়, তাঁর কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা, পরিচিতজন, তাঁর সন্তান-সন্ততি নিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন। এ ছাড়া তিনি তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য নানা ঘটনাসহ আশপাশের মানুষের কাজে লাগে এমন অনেক তথ্যও লিখে রাখতেন। পরবর্তী সময় আমরা পারিবারিকভাবে এসব ডায়েরি সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ, বিষয়টি আমাদের জন্য তো বটেই, সমাজের জন্যও জরুরি। তাঁর ছয়টি ডায়েরিতে লেখা সব তথ্যসহ পরিবারের সবার লেখা নিয়ে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে। গ্রন্থে তাঁর কিছু প্রিয় শিক্ষার্থী লেখার মাধ্যমে তাঁদের অনুভূতি জানিয়েছেন।
আজকের এই দিনে বাবার প্রতি শ্রদ্ধা। সবাই তাঁর জন্য দোয়া করবেন।
*লেখক: খ ম রেজাউল করিম, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর ও খোন্দকার তোজাম্মেল হকের ছেলে