এত অধঃপতন, নিতে পারছি না জাহাঙ্গীরনগর!
হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতায় জিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়তে আসেন এবং মেধাবী, মননশীল ও রুচিসম্পন্ন যেসব শিক্ষক পাঠদান করেন, উভয় পক্ষের সমন্বিত মন ও মানসিকতা আকাশের মতো উদার, সমুদ্রের মতো বিশাল আর পাহাড়ের মতো সুদৃঢ়—এমনটি জেনে এসেছি। সেই বিশ্বাস ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর।
আদি পাপে নিমজ্জিত হয়ে স্বর্গচ্যুত আমরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পৃথিবীর ঘানি টেনে চলেছি। আজকের জাহাঙ্গীরনগরের পাপ যেন সব সীমা লঙ্ঘন করে দিয়েছে। মনে বড় প্রশ্ন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন কারা পড়েন? পড়াতেই বা আসছেন কারা? বিচারহীন থাকার অন্যতম পরাকাষ্ঠা ‘মানিকদের’ প্রেতাত্মাদের পেলে পুষে দানবে পরিণত করে আসলে কাদের ফায়দা হাসিল হচ্ছে?
আর কবে বুঝবে জাহাঙ্গীরনগর যে লজ্জা রাখার শেষ জায়গাটি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা মুখ লুকানোর কোনো উপায় পাচ্ছি না। প্রিয় জাহাঙ্গীরনগর, তুমি কি তোমার সন্তানের অপমান গায়ে মাখবে না? এত বড় ন্যক্কারজনক ঘটনার পরও তুমি নড়েচড়ে বসবে না?
শিক্ষাদান কেবল ঠুনকো একটা দায়িত্ব পালন মাত্র নয়। এটি প্রকৃতিগতভাবেই পবিত্রতম ইবাদত। সেই ইবাদতে কলুষ লাগলে মানুষের বেঁচে থাকার আর কোনো মানে থাকে না। আমরা জাহাঙ্গীরনগরিয়ানরা এ মুহূর্তে যেন সত্যিই মরে বেঁচে আছি।
৫৩ বছর পেরিয়ে আসা একটি বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ব, স্বদেশ ও মানুষের বহু রূপ দেখতে দেখতে বর্তমান জায়গাটিতে উপনীত হয়েছে। তার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির ঝুলি ভরা থাকার কথা। যুগের পর যুগ বহু ত্যাগে আমরা মানবীয় সভ্যতা রপ্ত করে চলেছি। এমন একটা সময় সাপলুডুর ছকের নিয়ম মেনে অতিকায় অ্যানাকোন্ডার মুখে বোধ, বিবেক, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, প্রতীতি সব ঢেলে দিয়ে জঘন্য অবনমন তোমায় মানায় না জাহাঙ্গীরনগর!
তোমাকে যে অশুভ দুষ্টচক্র গিলে চলেছে জাহাঙ্গীরনগর, তাদের তুমি সত্বর বর্জন করো এবং এটা যত তাড়াতাড়ি পারবে তত শিগগির দোষ কাটিয়ে মানবতার মঙ্গল সাধন করতে পারবে। নচেৎ এক ঘোর অমানিশা তোমাকে গ্রাস করবে। আমরা চাই না জাহাঙ্গীরনগরের সূর্যে চিরতরে গ্রহণ লাগুক। শুভবোধের চন্দ্রিমা ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত হয়ে যাক।
গেল শনিবার রাতে স্বামীকে হলে আটকে রেখে এক নারীকে ক্যাম্পাসে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। যাতে জড়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান ছয় শিক্ষার্থী। ছয় শিক্ষার্থীর চারজনই ছাত্রলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা।
ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ কার্যালয়ের ৪ ফেব্রুয়ারি স্বাক্ষরিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেখেছি আমরা। সেখানে বলা হয়েছে, ধর্ষণের ঘটনায় মামলা দায়ের, জড়িত ব্যক্তিদের সাময়িক বহিষ্কার এবং অভিযুক্তদের সনদপত্র স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন এবং অবৈধভাবে হলে অবস্থানকারী সাবেক শিক্ষার্থীদের পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। ক্যাম্পাসে বহিরাগত ব্যক্তিদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে সবার জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে যে ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মীর মশাররফ হোসেন হল–লগ্ন এলাকায় জনৈক নারীকে পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে এনে সাবেক এক শিক্ষার্থী এবং বহিরাগত কিছুক্তি কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় প্রক্টরিয়াল বডির প্রাথমিক প্রতিবেদন গ্রহণ করে নিন্দনীয় এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দেশের প্রচলিত আইনে মামলা দায়ের, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁদের সাময়িক বহিষ্কার, সনদপত্র স্থগিত এবং তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। সিন্ডিকেট সভায় আবাসিক হলগুলোতে অবৈধভাবে অবস্থানরত সাবেক শিক্ষার্থীদের আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত তারিখের মধ্যে আবাসিক হল ছেড়ে চলে না গেলে তাঁদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়মে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সিন্ডিকেট সভায় ঘটনা তদন্ত এবং অপরাধীদের শাস্তির সুপারিশ করার লক্ষ্যে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন এবং আগামী ১৫ দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও ক্যাম্পাসে অনুমোদনহীন অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করা, ভাসমান দোকানপাট উচ্ছেদ এবং ক্যাম্পাসে বহিরাগত ব্যক্তিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং তাঁকে পালিয়ে যেতে সহায়তাকারী অপর তিনজনকে প্রক্টরিয়াল টিম এবং হল প্রশাসনের সহায়তায় পুলিশ ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে।
এটা হলো ভয়াবহ অপরাধের তাৎক্ষণিক নিদান। কিন্তু এমন উদ্বেগ ও বিপজ্জনক ঘটনা রোধ করার কার্যকারণ সম্পর্কে তেমন কিছু বলা হয়নি।
প্রথম আলো আজকে ‘একের পর এক অপকর্ম, প্রশাসন নির্বিকার’ শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে স্পষ্ট করে প্রতিবাদী শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলেছেন, বিভিন্ন সময় অপকর্মে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কঠোর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি; বরং অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনের প্রশ্রয় পাওয়ার অভিযোগ আছে। ফলে সৌন্দর্য ছাপিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ক্রমেই অপরাধীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সবাই।
যেকোনো সভ্য রাষ্ট্র হলেই গুরুতর ব্যর্থতার দায় মাথায় নিয়ে এতক্ষণে সভাসদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রধানের পদত্যাগ করার কথা। বাংলাদেশে অবশ্য নৈতিকতার এই চর্চা নেই বললে চলে। এখানে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার যে মোহ, তা থেকে কেউ নিস্তার নেয় না।
কার্যত প্রশাসনিকভাবে ব্যর্থদের মাথায় করে রাখতে গিয়ে জাহাঙ্গীরনগর নৈতিক মানদণ্ড কলুষযুক্ত করে ফেলেছে। ওখানে শুদ্ধ সাংস্কৃতিক চর্চা নেই। মূল্যবোধও অবক্ষয়ে নিপতিত হয়েছে। মানবিক বোধ জাগিয়ে দিতে পারেন, এমন মানুষের আজকাল ঘোর সংকট ওখানে। দেশের সেরা বিদ্যাপীঠের যদি এ অবস্থা হয়, অন্যান্য শিক্ষায়তনে কী হচ্ছে, খুব সহজে অনুমান করা যায়। জাতি হিসেবে এমন অবমাননাকর পরিস্থিতি কেন দেখতে হবে আমাদের?
সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, সব আসামি এখনো ধরা পড়েনি। যে কজন পুলিশি হেফাজতে আছে, তাদের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. নূরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অপরাধে আমরা বহিষ্কার করার পরও যারা হলে থাকে, তাদের কোনো এখতিয়ার নেই হলে থাকার। কোন কোন হলে বহিষ্কৃতরা থাকে, খোঁজ নিয়ে এখনই তাদের বের করার নির্দেশ দিচ্ছি।’
অপরাধীরা এখতিয়ার মেপে চলাচল করে না, এটা উপাচার্য স্যারও নিশ্চয়ই ভালো জানেন। তিনি এটাও জানেন, প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা কোন খুঁটির জোরে হলে পড়ে থেকে গাঁজার ডিলারশিপ বয়ে চলে, ছিনতাইয়ে জড়ায় এবং ধর্ষণের মতো চরম অপরাধে জড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস কলঙ্কিত করে! কিন্তু নিজেদের নিরঙ্কুশ পদের মায়ায় প্রশাসন তাদের ঘাঁটায় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ে করতে হবে উদ্ভাসিত সূর্যের চাষাবাদ। সেখানে সত্য, সুন্দর, মায়া আর মমতারা জড়াজড়ি করে থাকবে। ভয়াল অন্ধকার লালনকারীদের সমূলে নিপাত করা আমাদের সমস্বর দাবি। নিশ্চিন্তে ও নির্বিঘ্নে আমাদের মা, স্ত্রী ও কন্যাদের নিয়ে আমাদের নবজন্মের আঁতুড়ঘর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অরণ্যে যেতে চাই। আমাদের ভালোবাসার অপর নাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা গভীর বেদনায় আর বলতে চাই না, এত অধঃপতন! আর নিতে পারছি না জাহাঙ্গীরনগর!
লেখক: সাংবাদিক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]