প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা মানববৈচিত্র্যের অংশ। নানা ধরনের শারীরিক ও বুদ্ধিভিত্তিক সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁরা সমাজের মূল স্রোতধারার বাইরে। তাঁদের সমাজের মূল স্রোতে এনে স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিতে সরকার কাজ করছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতা বিবেচনায় প্রতিবন্ধিতার ধরনগুলো হচ্ছে অটিজম বা অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, বাক্প্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম, বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা।
প্রতিবন্ধিতার ধরনগুলোর মধ্যে চারটি প্রতিবন্ধিতা অটিজম বা অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডারস, ডাউন সিনড্রোম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা ও সেরিব্রাল পালসিকে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী বা সংক্ষেপে এনডিডি বলে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট শনাক্তকৃত প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ২৯ লাখ ৯৯ হাজার ৮৩৯ জন, যার মধ্যে অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ৭৮ হাজার ২১৬, ডাউন সিনড্রোম ৬ হাজার ১৪, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ২ লাখ ৬ হাজার ৯৮৭ ও সেরিব্রাল পালসি ১ লাখ ১৩ হাজার ১৬০ জন।
এনডিডি সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ধারণার পরিবর্তন জরুরি। অনেক মা-বাবা মনে করেন, অটিজম প্রতিবন্ধিতা নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, অটিজম একধরনের প্রতিবন্ধিতা। শুধু শিশুরাই অটিজমে আক্রান্ত হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, এটি একটি জীবনব্যাপী অবস্থা। তবে শিশু বয়সেই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। চিকিৎসা, সময়মতো ও নিয়মিত সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে প্রায় স্বাভাবিক অথবা পরিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারে। প্রতিবন্ধিতার কারণ যা-ই হোক না কেন, এগুলোর ওপর বাবা-মায়ের কোনো হাত নেই। তাই সন্তানের প্রতিবন্ধিতার জন্য মা-বাবাকে দোষারোপ বা দায়ী করা ঠিক নয়।
অনেকেরই ধারণা, বিদ্যালয় বা সেবাকেন্দ্রে পরিচর্যা করলেই তো শিশু ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। বাস্তবতা হচ্ছে, শুধু বিদ্যালয় বা সেবাকেন্দ্রে সীমিত সময়ের পরিচর্যা যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি বাড়িতে অভিভাবকদের পরিচর্যার ধারাবাহিকতা এবং সেবা ছাড়া এসব শিশুর অবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়।
অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সব ব্যক্তির বিশেষ কোনো দক্ষতা থাকে? বাস্তবতা হচ্ছে, অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কিছু ব্যক্তির মধ্যে বিশেষ কোনো গুণ বা দক্ষতা থাকতে পারে, কিন্তু সবার মধ্যেই বিশেষ কোনো গুণ বা দক্ষতা থাকবে, তা ঠিক নয়। ডাউন সিনড্রোমসম্পন্ন শিশু খুব বেশি দিন বাঁচে না। বাস্তবতা হচ্ছে, নিয়মিত সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যা পেলে এবং পরিমিত খাবার গ্রহণের মাধ্যমে এরা দীর্ঘদিন বাঁচতে পারে।
২
এনডিডি শিশু ও ব্যক্তিদের স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিতে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা প্রতিপালন ও আন্তর্জাতিক সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিতকল্পে অটিজমসহ স্নায়ুবিকাশজনিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে ২০১৩ সালে ‘নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট আইন’ প্রণয়ন করে। এ আইনের বিধান অনুসারে, ২০১৪ সালে নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা, জীবনমান উন্নয়ন, আবাসন ও পুনর্বাসনের জন্য নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এনডিডি ট্রাস্ট হতে এনডিডি ব্যক্তিদের এককালীন ১০ হাজার টাকা করে চিকিৎসা অনুদান প্রদান; অতিদরিদ্র এনডিডি শিশু ও ব্যক্তিকে বড় ধরনের চিকিৎসা ও থেরাপি-সংক্রান্ত ব্যয়ের জন্য এনডিডি ট্রাস্টি বোর্ডের অনুমোদনের ভিত্তিতে বিশেষ অনুদান প্রদান; এনডিডি শিশু ও ব্যক্তির মা-বাবা ও কেয়ারগিভারদের প্রশিক্ষণ প্রদান; বিশেষ স্কুলের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান; প্রতিবন্ধিতা-সম্পর্কিত সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা ২০১৯ প্রণয়ন করে এনডিডি শিশুদের সমন্বিত শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা; এনডিডি শিক্ষার্থীদের উপযোগী শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে এনডিডি সুরক্ষা ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানে বিশেষ কারিকুলাম প্রণয়ন কার্যক্রম চলমান। ইতিমধ্যে এর গাইডলাইন প্রস্তুত করা হয়েছে; অটিজম শনাক্তকরণ ও মাত্রা নিরূপণের জন্য ‘স্মার্ট অটিজম বার্তা’ ও ‘বলতে চাই’ নামের অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে। এনডিডি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিশু ও ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকল্পে ‘বঙ্গবন্ধু সুরক্ষা বিমা’ চালু করা হয়েছে। এ বিমার আওতায় ৩ থেকে ২৫ বছর বয়সের সুবর্ণ কার্ডধারী বিমা গ্রাহকেরা নির্ধারিত সীমার মধ্যে হাসপাতালে ভর্তির পূর্ব ও পরবর্তী ব্যয় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিল সাপেক্ষে পুনর্ভরণ করা হবে। নির্ধারিত সীমার ওপর ভিত্তি করে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত বিমা সুবিধা প্রদান করা হবে। এ বিমার পাইলটিং কার্যক্রমের অওতায় ৫০৪ জন এনডিডি শিশু ও ব্যক্তি এ বিমা গ্রহণ করেছে। নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য গৃহীত দেশের ১৪টি স্থানে ১৪টি ‘অটিজম ও এনডিডি সেবাকেন্দ্র’ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান। ১৫তম ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস, ২০২২’ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘোষিত নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য , কর্মসংস্থান, আবাসন ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে গৃহীত ‘দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরে ৮টি আবাসন ও পুনর্বাসনকেন্দ্র স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন সমাপ্তির পর্যায়ে রয়েছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এত চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে এত ভুল ধারণা থাকা সত্ত্বেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা ঘরে বসে নেই। সারা বিশ্বে যেভাবে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এগিয়ে যাচ্ছেন, বাংলাদেশেও তাঁরা খুব বেশি পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নে একাগ্রভাবে বিশ্বাসী। পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগেও প্রচুর কাজ হচ্ছে। সরকার আইন, নীতিমালা, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মকৌশল নির্ধারণ করে এগুলোর বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। প্রতিবছর ২ এপ্রিল তারিখে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস দেশব্যাপী যথযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়ে থাকে এবং এ বিষয়ে বিশেষ অবদান রাখা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা প্রদান করা হয়ে থাকে। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে শিশু বিকাশকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি জেলায় এবং বেশ কিছু উপজেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রগুলোতে অটিজম কর্নার চালু করা হয়েছে। বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগেও সারা দেশে বিদ্যালয় ও সেবাকেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এগুলোতে শিক্ষার পাশাপাশি তাঁদের কর্মক্ষম করার উদ্দেশ্যে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। সরকারি প্রণোদনার কারণে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজধানীর বাইরে আরও প্রশিক্ষণ ও সেবাকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ছাড়া তাঁদের শনাক্তকরণ, চিকিৎসা, পরিচর্যা ও পুনর্বাসনসেবা নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় থেকে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান/কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকায় ইনস্টিটিউট ফর পেডিয়াট্রিক নিউরো-ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (IPNA), শিশু ও কিশোর মনোরোগবিদ্যা বিভাগ স্থাপন করা হয়েছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শেরে-বাংলা নগর, ঢাকা; মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু ও মানসিক রোগ বহির্বিভাগ; বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজের শিশু বিকাশ কেন্দ্র; জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল; সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতাধীন জেলা সমাজসেবা কার্যালয়সহ বিভিন্ন ইউনিট ও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে এনডিডি ব্যক্তিদের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। ভ্রাম্যমাণ ওয়ান স্টপ থেরাপি সার্ভিস (মোবাইল ভ্যান) ও প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রগুলোতে এনডিডিসহ সব ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিহ্নিতকরণ, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসহ কাউন্সিলিং, ফিজিওথেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপি, সহায়ক উপকরণ ইত্যাদি বিনা মূল্যে প্রদান করা হচ্ছে।
আমাদের যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুযোগ ও সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন করলেই প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তিরা পরিবারের ও সমাজের বোঝা না হয়ে তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে। তবে এ দায়িত্ব পালনের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হলো, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি আমাদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন।
এনডিডি বিষয়ে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আপনার শিশু বা পরিবারের কোনো সদস্যকে জন্মের পর থেকে যেকোনো বয়সেই অস্বাভাবিক মনে হলে নিকটস্থ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র/হাসপাতালে নিয়ে যান। তাঁর মধ্যে কোনো প্রকারের প্রতিবন্ধিতা আছে কি না, তা চিকিৎসকের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন। সন্তান বা পরিবারের সদস্য প্রতিবন্ধী হলে না ঘাবড়িয়ে, না লুকিয়ে, তাঁকে চিকিৎসা ও নিয়মিতভাবে পরিচর্যা করুন। নিকটস্থ সমাজসেবা কার্যালয়ে গিয়ে প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপের আওতায় আনুন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর, জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট থেকে প্রদত্ত সেবা গ্রহণ করুন। সমাজের অন্য সবার মতো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরও আছে মুক্ত পরিবেশে জীবন উপভোগ করার সমান অধিকার।
লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার, (জনসংযোগ কর্মকর্তা), সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়
**নাগরিক সংবাদে লেখা ও ছবি পাঠাতে পারেন [email protected] এ