বাংলাদেশ রেলওয়ে আর মিরসরাই দুর্ঘটনা

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের মানুষের (পুরুষ) গড় উচ্চতা ৫ ফিট ৪ ইঞ্চির সামান্য বেশি অর্থাৎ, ১৬৩ সেন্টিমিটার। ব্রিটিশদের গড় উচ্চতা ৫ ফিট ৯ ইঞ্চি। তবে দুই দেশের বাড়ির দরজার উচ্চতা একই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশিরা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘরে আলিবাবার কাস্টম সাইজের দরজা ফিট করছে।

আসল কথায় আসা যাক।
ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশের রেল অবকাঠামোগুলো তৈরি হয়। এখন পর্যন্ত অধিকাংশ রেল ও রেললাইন তাদেরই দিয়ে যাওয়া প্রযুক্তিগত উপহার, যা আমরা ব্যবহার করে আসছি। তাদের দেশে এখন হাই স্পিডের পাতাল রেলও চলে। তখনকার সময়ে ব্রিটিশরা অন্যান্য সড়কপথে চালিত যানবাহন, এমনকি জনগণের চেয়েও চলন্ত রেলগাড়িকে বেশি প্রাধান্য দিত।

বাড়ির দরজার মতো তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশের রেলব্যবস্থা এখনো সেভাবেই চলছে। কিন্তু দেশের যে যোগাযোগব্যবস্থার নাজেহাল অবস্থা, কিংবা ছোট্ট দেশের জনসংখ্যা যে ১৬ কোটি ৫০ লাখেরও বেশি (জনশুমারির পরিসংখ্যানে) সে তফাত আমরা মেনে নিতে নারাজ।

আমাদের গড় উচ্চতা ৫ ফিট ৪ ইঞ্চি হলে কী হবে, আমরা ইউরোপীয়দের সাইজে দরজা বানাব। আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা নিয়মের মধ্যে থাকুক না থাকুক, তাতে কী হয়েছে, আমরা ব্রিটিশদের দিয়ে যাওয়া নিয়মেই ট্রেন চালাব, এতে কতজন দুর্ঘটনায় মরল অথবা কার একচোখ কানা থাকল, সে দায় রেল কর্তৃপক্ষ নেবে না। আমাদের জনসংখ্যা বেশি, আমরা ট্রেনে কতজন উঠলাম না উঠলাম, নাকি ছাদে উঠে গেলাম, সেটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে শুধু পশ্চিমাদের ননস্টপ নিয়মকানুন ছাড়তে পারব না ভাই। আমাদের রেলপথের তুলনায় সড়কপথ শতগুণ ব্যস্ত, তাতে কী হয়েছে, আমরা পশ্চিমাদের মতো হতে চাই। আমরা শিক্ষিত বাহাদুর।

আমাদের দেশে কোনোকিছুতেই শৃঙ্খলা নেই। জনগণও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু রেলক্রসিং মেইনটেইন করার লোকের বেশ অভাব। দায়িত্ব গ্রহণের অভাব। রেলগেটে অস্থায়ী অপ্রশিক্ষিত ওয়েম্যান দিয়ে চলছে গেটম্যানের কাজ। সেই গেটম্যানও বোধ হয় টাইমটেবল না বুঝে চা-বিড়ি খেতে এদিক–ওদিক যান! এ যেন ‘সরকারি মাল দরিয়ায় ঢাল’ মাস গেলেই বেতন–প্রথা চলছে দেশ।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রেল রুটে একটা যাত্রী নিয়ে রেল একাই যাবে, একে ডিস্টার্ব করা যাবে না। গাড়ির সম্মুখে হাজার লোক থাকলেও রেল থামবে না, কতজন মারা পড়ে পড়ুক, যদি না লালজাতীয় কাপড় দিয়ে সংকেত বা সতর্কবাণী না দেখানো হয়। আমরা চোখ দিয়ে দেখি না, ব্রিটিশদের চোখ দিয়ে মানবতাকে বিচার করছি। ব্রিটিশরা যেভাবে শোষণ করত, সেই শোষণকেই বাংলার বুকে নিয়ম হিসেবে বেঁধে দিয়েছি। ২০০–৩০০ বছর ধরে তা করেই চলছি।

গত ২৯ জুলাই ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেওয়া মহানগর প্রভাতী নামক ট্রেনটি মিরসরাইয়ে ১৫ আরোহী বহন করা একটি মাইক্রোবাসকে রাস্তা পারাপারের সময় আঘাত করে। স্পটেই ১১ জনের মৃত্যু। ওরা সবাই ছাত্র। আহত মাইক্রোবাসটিকে পুরো এক কিলোমিটার ঠেলে নিয়ে যায় ট্রেনটি। এটাও কী সম্ভব!

আমরা জানি, এখানে মাইক্রোবাস ও ট্রেন উভয়েরই দোষ নেই। দোষ গেটম্যানের। আরও নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের দোষারোপ করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু কাউকে একবারও বলতে শুনলাম না, বাংলাদেশের ট্রেন কি এমন ভিআইপি হয়েছে, তাকে পুরো দেশ ছেড়ে দিতে হবে? ট্রেন দেশের কত শতাংশ যাত্রী বহন করছে আর কত শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে, এ নিয়ে কাউকে ট্রেনের সমালোচনা করতে শুনলাম না। দুঃখ!

যত বড় মাথা নেই তত বড় গতিশীল ল্যাবরেটরি খুলে বসলে চলবে না, আগে সুস্থ যোগাযোগব্যবস্থা এবং এর নিরাপত্তা তৈরি করতে হবে, তারপর জাপানি স্টাইলে হাই স্পিড ট্রেন চালু হোক মাননীয় রেল...।

*এ দেশের রেলব্যবস্থা আর ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে কোনো তফাত নেই। দুটিরই কার্যক্রম আছে, তবে মানসম্পন্ন ফিগার নেই।


*লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা।