দক্ষিণ এশিয়ার টেকসই উন্নয়ন ও বাস্তবতা

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের সমন্বয়ে আঞ্চলিকভাবে পরিবেষ্টিত ভূখণ্ড দক্ষিণ এশিয়া, যা এশিয়া মহাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে অবস্থিত। স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি দেশের নিজস্ব দর্শন, মতাদর্শ ও স্বাধীন সার্বভৌমত্ব অধিকার রয়েছে। সেই দর্শন, ভাবাদর্শ ওই দেশের মানুষের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে ফুটে ওঠে, যা দেশগুলোর স্বতন্ত্র সত্তা বহন করে দেশীয় ও বৈশ্বিক মানচিত্রে।

যেসব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি সেসব কর্মকাণ্ড যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে ঘাটতি বা বাধার কোনো কারণ না হয়ে দাঁড়ায়, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ রেখে পরিকল্পিত উন্নয়নই হলো টেকসই উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়নের ফলে একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হয়। রাষ্ট্রের উন্নয়নশীল জীবন অর্জনের ক্ষেত্রে যে অর্থনৈতিক ঘাটতিগুলো থাকে, সেগুলো চিহ্নিত করে ঘাটতিগুলো দূর করা হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মানবাধিকার চাহিদা, রাজস্ব বৃদ্ধিসহ রাষ্ট্রের পারিপার্শ্বিক স্বতন্ত্র অবস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে টেকসই উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রার দরুন ক্ষুধা–দারিদ্র্যমুক্ত অর্থনীতি এবং শান্তিপূর্ণ ন্যায়বিচার ও সুশাসন নিশ্চিত হবে সমাজে।

দক্ষিণ এশিয়ায় রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম যুব শ্রমশক্তি, যেখানে প্রতিদিন প্রায় এক লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছেন। তাঁদের কাজে লাগিয়ে বাকি বিশ্বের দৃষ্টি সহজেই কাড়তে পারে এ অঞ্চল। ফলে সমাধান হচ্ছে টেকসই উন্নয়ন। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো প্রকল্পভিত্তিক কর্মকাণ্ড প্রণয়ন করলে দেশগুলোর সামাজিক সমস্যা হ্রাস পাবে। অর্থনীতির ঘাটতিগুলো দূর হবে। শিক্ষা ও সেবার মান উন্নীত হবে। সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার প্রভাবে সাধারণ মানুষের ইতিবাচক আচরণ ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার বিনিময়ে জীবনমান হবে আধুনিকতার মিশেলে।

বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৩ কোটি ৮৪ লাখ জনসংখ্যার দেশ আফগানিস্তানের প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষই এখন চরম খাদ্যাভাবে ভুগছে, যার মধ্যে প্রায় ৯০ লাখ লোক এখন দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি। অপর দিকে বাংলাদেশে গত জুনে মুদ্রাস্ফীতি ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। জুলাই মাসে কিছুটা কমেছে।

রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। পাকিস্তানে জুন মাসে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ২১ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মালদ্বীপে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়তে দেখা গেছে। এ ঋণের পরিমাণ তাদের জিডিপির তুলনায় ১০০ শতাংশের বেশি। নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এখন ৯ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে, যা একটি খুবই বিপজ্জনক অবস্থা। পাশাপাশি রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া নিত্যপণ্যের আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রম আগের তুলনায় সচল নয় বিধায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে। তাই মোটাদাগে বলতে গেলে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা গুরুতর সময় পার করছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় সামাজিক সুরক্ষার কৌশল ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক উন্নয়ন সংস্থা সার্ককে ঢেলে সাজাতে হবে এবং কমিউনিটি এক্সচেঞ্জ নীতির মাধ্যমে প্রতিটি দেশে সার্কের কার্যক্রম গতিশীল করতে হবে। কর্মমুখী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ নির্মাণ করে এ অঞ্চলে বেকারত্ব সমস্যা হ্রাস করতে হবে।বিশ্বমানের যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সহজতর আধুনিক যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে উদ্ভাবনমূলক অর্থনীতির কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করতে হবে।

প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ ও সীমান্তজনিত সমস্যা সমাধান করতে হবে। এর জন্য শান্তিপূর্ণ সংলাপের আয়োজন করতে হবে। এ অঞ্চলে গবেষণা খাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নিজেদের দেশের সীমাবদ্ধ সম্পদের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে দেশের অর্থনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান তৈরি করতে হবে। জ্বালানি সাশ্রয়ে অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ ছাড়া প্রতিটি দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক খাতগুলোকে গবেষণানির্ভর করতে হবে, যাতে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন এর পথরেখা রচিত হয় দেশগুলোতে। সদিচ্ছার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার ঐক্য ও সম্প্রীতির ঝান্ডা রূপায়ণ লাভ করবে বিশ্বব্যাপী। এর সুফল ভোগ করবে দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ জনগণ থেকে বিশ্ববাসী।


*লেখক: শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান, শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়