রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এলমহার্স্ট ও শ্রীনিকেতন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করতেন। গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গ্রামীণ উন্নয়ন–ভাবনাকে দুটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়—শিলাইদহ পর্ব এবং শ্রীনিকেতন পর্ব। রবীন্দ্রনাথ জোর দিয়ে বলেন, গ্রামীণ দারিদ্র্যের মূল কারণ হলো গ্রামের মানুষের আত্মবিশ্বাসের অভাব, যা তাদের সর্বদাই সরকারের মুখাপেক্ষী করে তোলে। তাই ঐক্যের মাধ্যমে গ্রামের মানুষের আত্মশক্তি জাগিয়ে তোলাকে তিনি প্রাথমিক কাজ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি পূর্ব বাংলায় জমিদারি পরিচালনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। পদ্মার পাড়ের দুঃখী মানুষকে খুব কাছ থেকে তিনি দেখেছেন। তাদের সঙ্গে গভীরভাবে মিশেছেন। এসব থেকেই গ্রামীণ উন্নয়নের বিভিন্ন উদ্যোগের পরিকল্পনা মাথায় আসে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২১ সালে শান্তিনিকেতন থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত সুরুল গ্রামে কৃষি ও পল্লি উন্নয়নের কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী ‘শ্রীনিকেতন’ নামে পরিচিতি পায়। তিনি মার্কিন কৃষি অর্থনীতিবিদ লিওনার্ড এলমহার্স্টের সক্রিয় সাহায্য এবং আর্থিক সহযোগিতায় পল্লি উন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়াকে আমরা তাঁর দ্বিতীয় পর্যায়ের পল্লি উন্নয়ন বিপ্লব বলতে পারি। বোলপুরের সুরুল গ্রামের কুঠিবাড়িটি স্থানীয় সিংহ পরিবার থেকে কিনে সেটিতে কৃষি গবেষণার কাজ শুরু হয়। সেখানে চামড়া, সুচ, মাটি, শতরঞ্জি বুনন এবং ছাপার যন্ত্রের কাজ চলতে শুরু হয়। ভারতের বিভিন্ন জেলা থেকে বিভিন্ন রকম কারুশিল্পের নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং সে অনুযায়ী শুরু হয় বিভিন্ন রকম উদ্যোগ।

১৯২২-২৫ পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর লিওনার্ড এলমহার্স্ট কবিগুরুর সান্নিধ্যে এসেছিলেন। শান্তিনিকেতনের অদূরে সুরুল গ্রামে এলমহার্স্ট ও শান্তিনিকেতনের কিছু ছাত্র-শিক্ষকের সহায়তায় রবীন্দ্রনাথ ‘পল্লি সংগঠন কেন্দ্র’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতিসাধন, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগ নিবারণ, সমবায় প্রথায় ধর্মগোলা স্থাপন, চিকিৎসার সুব্যবস্থা এবং সাধারণ গ্রামবাসীর মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি করা। লিওনার্ড এলমহার্স্টের ‘গ্রামীণ পুনর্গঠন প্রতিষ্ঠান’ প্রকল্প ভাবনাটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল।

এলমহার্স্টকে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিঠিতেও তার প্রমাণ দেখি, ‘যখন আপনি এসেছিলেন (শান্তিনিকেতন) তখন আপনি ছিলেন তরুণ কিন্তু আপনি কোনো অংশেই একজন পণ্ডিত এবং প্রাজ্ঞ শিক্ষাবিদের থেকে কিছু কম ছিলেন না। মানুষের প্রতি আপনার দরদ এবং দায়বদ্ধতাই ছিল আপনার প্রধান শক্তি, যা আপনাকে আপনার শত প্রতিকূলতায়ও শক্ত হয়ে দাঁড়াতে শক্তি জুগিয়েছে। আপনি যথাযথভাবেই আপনার কাজকে গ্রামীণ পুনর্গঠনের কাজ বলে অভিহিত করেছেন, যা আমাদের পল্লিসমাজের জীবন উন্নয়ন কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করেছে।’

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখভাল করার জন্য বিভিন্ন অভিজ্ঞতা পান। অর্জিত এসব অভিজ্ঞতা শ্রীনিকেতনে প্রয়োগ করেন। শ্রীনিকেতন প্রকল্পের মাধ্যমে তিনি গ্রামোন্নয়নের যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করেন, সেগুলোর অন্যতম:

১. স্বদেশি শিল্পজাত দ্রব্য প্রচলন। এগুলো সুলভ ও সহজপ্রাচ্য করার জন্য ব্যবস্থা এবং সাধারণ ও স্থানীয় শিল্পোন্নতির চেষ্টা।

২. আদর্শ কৃষিক্ষেত্র ও খামার স্থাপন এবং গ্রামবাসীকে কৃষিকর্ম বা গো-মহিষাদি পালন দ্বারা জীবিকা উপার্জনোপযোগী শিক্ষা প্রদান ও কৃষিকর্মের উন্নতিসাধন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাদানব্যবস্থাকে কার্যকর করার জন্য শান্তিনিকেতনের পরিপূরক রূপে গড়ে তুলেছিলেন এ শ্রীনিকেতন। শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন নিয়েই ছিল রবীন্দ্রনাথের সব সময়ের চিন্তা। একদিকে শিক্ষায় মনের মুক্তি খোঁজা, অন্যদিকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে উপেক্ষিত পল্লিবাসীর উদ্ধারের পথ অনুসন্ধান। গ্রামোন্নয়ন সম্পর্কে কবির (শ্রীনিকেতনের ইতিহাস ও আদর্শ; পল্লিপ্রকৃতি, পৃ. ৩৭৭) বক্তব্য, ‘আমি একলা সমস্ত ভারতবর্ষের দায়িত্ব নিতে পারব না, আমি কেবল জয় করব একটি বা দুটি গ্রাম।...আমি যদি কেবল দুটি-তিনটি গ্রামকেও মুক্তি দিতে পারি অজ্ঞতা, অক্ষমতার বন্ধন থেকে, তবে সেখানেই সমগ্র ভারতের একটি ছোট আদর্শ তৈরী হবে...।’

মেলার মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের সংযোগ-সাধন হয়, গ্রামীণ কুটিরশিল্পের বিক্রয় এবং গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে দেশবাসীর পরিচয়–সাধনও হয়। মেলার গুরুত্ব নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন। শিলাইদহে ১৯০৫-এ আয়োজন হয়েছিল কাত্যায়নী মেলার। এর দুই বছর পর হয় রাজরাজেশ্বরী মেলা। শ্রীনিকেতন প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামোন্নয়ন করতে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করতে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব অনুধাবন করেন তিনি। ফলে ভাবনা আসে, শ্রীনিকেতনের বার্ষিক উৎসব উপলক্ষে একটি গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা দরকার। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে মার্কিন কৃষি-অর্থনীতিবিদ লিওনার্ড এলমহার্স্টকে লেখেন, ‘…I hope, you will establish an annual Mela (fair) of your own at Surul and encourage the holding of lantern lectures and of games during it as well as the usual dramas and dance (Poet and Plowman, page-12)’। শ্রীনিকেতন পর্বে পৌষমেলা, শ্রীনিকেতন মেলা হয়। মেলাটি বাস্তবিকই একটি চমৎকার মিলনক্ষেত্র। এখানে পল্লিশ্রীর রূপ, গ্রামলক্ষ্মীর রূপ ফুটে ওঠে। আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষের এবং অন্যান্য পণ্যের মানোন্নয়নের বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রামের চাষিরা জানতে পারেন। গ্রামীণ সংস্কৃতি ও কৃষ্টি এই গ্রামীণ মেলায় তুলে ধরা হয়। গ্রাম ও শহর—দুইই এ মেলা থেকে সমানভাবে উপকৃত হয়ে থাকে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কথায়, ‘মেলা ভারতের পল্লীর সর্বজনীন উৎসব। কোনো উৎসব প্রাঙ্গণের মুক্ত অঙ্গনে সকল গ্রামবাসীর মনের উচ্ছ্বসিত মিলনক্ষেত্র হইল মেলা’। ১৯০৪ সালের পর থেকে রবীন্দ্রনাথ পল্লিসমাজের ওপর গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯০৭ সালে পাবনার এক প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা দাও, কৃষিশিল্প ও গ্রামের ব্যবহারসামগ্রী সম্বন্ধে নূতন চেষ্টা প্রবর্তিত করো; গ্রামবাসীদের বাসস্থান যাহাতে পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর হয়, তাহাদের মধ্যে সেই উৎসাহ সঞ্চার করো এবং যাহাতে তাহারা নিজেরা সমবেত হইয়া গ্রামের সমস্ত কর্তব্য সম্পন্ন করে সেইরূপ বিধি উদ্ভাবিত করো।’ এই ভাবনা থেকে তিনি কালীমোহন ঘোষকে পতিসর নিয়ে এলেন ধানভানা কলের ব্যবস্থা করার জন্য।

রবীন্দ্রনাথ কৃষকপ্রধান ভারতবর্ষে বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করতেন। তাই পল্লি উন্নয়নে নানামাত্রিক প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নিজের সন্তান ও জামাতাকে কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে এনেছিলেন। পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায় লেখেন, ‘আমাদের দেশে পল্লিসঞ্জীবনের কাজে প্রথম পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ। দ্বিতীয়, অর্থাৎ পল্লিসঞ্জীবনে প্রধান সহায়ক পাশ্চাত্যবাসী এলমহার্স্ট এবং প্রাচ্যবাসী কালীমোহন ঘোষ। ১৯২০-তে রবীন্দ্রনাথের আমেরিকা ভ্রমণকালে কৃষিবিদ্যা শিক্ষার্থী এলমহার্স্টের সঙ্গে তাঁর আলাপ। এলমহার্স্ট সূত্রে জানা যায় টাকা দিয়েছিলেন আমেরিকার ডরোথি স্ট্রেট। অনেক টাকা। গ্রামীণ জীবিকা উন্নয়নে শস্য, কল ও শিল্প-প্রক্রিয়াজাতকরণ), সমবায় সামাজিক পুঁজি, অর্থায়ন এবং প্রশিক্ষণ ইত্যাদির গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বিশ্বকবি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সাধারণ পল্লিসমাজের আধুনিকায়ন না ঘটলে ভারতের কোনো উন্নয়ন হবে না।

লেখক: আবু আফজাল সালেহ, কবি ও প্রাবন্ধিক, উপপরিচালক, বিআরডিবি, কুষ্টিয়া