এআই বনাম ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড: বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

বাংলাদেশ পৃথিবীর অষ্টম জনসংখ্যাবহুল দেশ। জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২–এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ১১৯ জন লোক বাস করে। ক্ষুদ্রায়তনের এই দেশে বিশাল এই জনসংখ্যা দেশের জন্য আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ, তা নিয়ে নানা মতবাদ রয়েছে। দুই ধরনের অবস্থানের পক্ষে-বিপক্ষে রয়েছে শক্তিশালী তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ।

থমাস রবার্ট ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব অনুযায়ী, খাদ্য উৎপাদন যেখানে গাণিতিক হারে বাড়ে, জনসংখ্যা সেখানে জ্যামিতিক হারে বাড়ে।

ফলে উদ্বৃত্ত জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান দিতে দেশে সংকট বা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। এ তত্ত্বে মূলত নিষ্ক্রিয় সত্তা হিসেবে ব্যক্তি কর্তৃক সম্পদ ভোগ বা ব্যয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে মার্ক্সবাদী তত্ত্বে, উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় ব্যক্তির ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিশেষ করে এ তাত্ত্বিক বিতর্কের কোনো একক পক্ষে অবস্থান নেওয়া খুবই দুরুহ ও ক্রমবর্ধমান জটিলতার বিষয়ও বটে। কারণ, এখানে জনসংখ্যার কোন দিকটি আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ—প্রাধান্য বিস্তার করবে তা কতগুলো কাঠামোগত বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।

কাঠামোগত বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে জনসংখ্যার বয়সভিত্তিক বিভাজন।

অর্থাৎ দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী এবং নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর অনুপাত। যখন কোনো দেশে কর্মক্ষম জনসংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশকে ছাড়িয়ে যায়, তখন সে দেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে অবস্থান বা জনমিতিক মুনাফায় অবস্থান করছে বলে ধরে নেওয়া হয়।

অষ্টম অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি ৩০ লাখ
ফাইল ছবি

জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের সংজ্ঞা অনুযায়ী ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড হলো, ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি সম্ভাবনা, যা জনসংখ্যার কাঠামোগত পরিবর্তন। প্রধানত কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫-৬৪ বছর) যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যাকে (০-১৪ বছর এবং ৬৫ বছরের উর্ধ্বে) ছাড়িয়ে যায়।’ বাংলাদেশ বর্তমানে তার অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এ বিশেষ ধাপ অতিক্রম করছে। জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২ অনুযায়ী দেশে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১১ কোটি ৭ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ৬৫.২৩ শতাংশ। তবে এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের যথাযথ সুফল পাওয়ার জন্য প্রধান শর্ত হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা। একবিংশ শতাব্দীতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলা ও ২০৪১ নাগাদ বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলা এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে একদিকে যেমন জনসংখ্যাত লভ্যাংশকে শতভাগ কাজে লাগানো অতীব জরুরি, অন্যদিকে এ লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়নে প্রযুক্তি–নির্ভরতা বিশেষ করে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বহুমুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে, যদি ঠিক সময়ে যথাযথ পদক্ষেপ বাস্তবায়ন না করা হয়। উল্লেখ্য, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাতটি খাত জাতীয় অগ্রাধিকার পেয়েছে যেমন সরকারি পরিষেবা সরবরাহ; কৃষি, শিল্প, শিক্ষা ও দক্ষতা; স্বাস্থ্যসেবা, অর্থ ও বাণিজ্য এবং স্মার্ট মোবিলিটি ও পরিবহন খাত।

চ্যালেঞ্জসমূহ—

প্রথমত, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০০ মিলিয়ন লোক চাকরি হারাতে পারে, যার মধ্যে ৫ দশমিক ৭ মিলিয়ন অদক্ষ বাংলাদেশিও রয়েছেন, যাঁরা দেশে ও বিদেশে কাজ করছেন। অর্থাৎ অটোমেশন এবং এআই-চালিত প্রযুক্তি ঐতিহ্যগত চাকরিগুলোকে স্থানচ্যুত করতে পারে, যা বাংলাদেশের বৃহৎ এবং তরুণ শ্রমশক্তির নিকট উদ্বেগের বিষয়। অধিকন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন ‘শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২’ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৩০ হাজার জন।

দ্বিতীয়ত, এআই-সম্পর্কিত দক্ষতা, জ্ঞানসহ কর্মী বাহিনী প্রস্তুত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষাব্যবস্থা যাতে ক্রমবর্ধমান চাকরির বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় তা নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জ।

তৃতীয়ত, যদি এ গ্রহণ অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায়সঙ্গত না হয়, তবে এটি দেশে আয়বৈষম্য বাড়িয়ে তুলতে পারে। যার ফলে সামাজিক বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করবে।

চতুর্থত, ডিজিটাল ডিভাইড সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ এআইসহ প্রযুক্তির সব সুবিধা সব নাগরিকের কাছে অ্যাকসেসযোগ্য করা চ্যালেঞ্জিং হতে পারে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যেখানে ডিজিটাল অবকাঠামো অপর্যাপ্ত।

পঞ্চম, নৈতিক ও গোপনীয়তার উদ্বেগ-নৈতিক সমস্যা এবং ডেটা গোপনীয়তার উদ্বেগগুলো মোকাবিলা করা যেহেতু এআই সমাজে আরও বেশি জটিল হয়ে উঠছে, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো কালচারাল ল্যাগ সোসাইটিতে জনসাধারণের আস্থা ও বিশ্বাস বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

ষষ্ঠ, এআইয়ের জন্য কার্যকর বিধান ও শাসনকাঠামো তৈরি করা জটিল, কিন্তু অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দায়িত্বশীল ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয়।

সপ্তম, এআইয়ের একীভূতকরণ বিদ্যমান সামাজিক নিয়ম ও মূল্যবোধ চ্যালেঞ্জ করতে পারে, যা প্রতিরোধ বা অভিযোজন সমস্যার দিকে ধাবিত করবে।

অষ্টম, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বিশ্বে আর্থসামাজিক অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের পাশাপাশি গ্লোবাল-এআই ল্যান্ডস্কেপে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য গবেষণা, উদ্ভাবন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি সুরক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ একটি চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যাগত লভ্যাংশের দেশের প্রেক্ষাপটে এআইয়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন, যেখানে সমাজের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।

প্রথমত, শিক্ষা আধুনিক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যা প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে গতিশীলতা আনয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে, যা জনসংখ্যার সব অংশের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অ্যাকসেসযোগ্য হবে।

দ্বিতীয়ত, মাইক্রো বা ব্যক্তি পর্যায়ে এআই প্রযুক্তিগত সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য ডিজিটাল সাক্ষরতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে, বিশেষ করে বয়সভিত্তিক ডিজিটাল বিভাজন হ্রাস করার জন্য।
তৃতীয়ত, সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক চ্যালেঞ্জ মেকাবিলায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংহতির ওপর জোর দেওয়া হয়।

চতুর্থত, সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতার পাশাপাশি এআই ব্যবহারের জন্য নৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং এর প্রসার ঘটাতে হবে।

পঞ্চম, সামাজিক সমতা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য সম্ভাব্য সামাজিক প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করে এআইয়ের কারণে চাকরি স্থানচ্যুতির প্রভাব প্রশমিত করতে সামাজিক নিরাপত্তা জাল এবং সহায়তা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।

ষষ্ঠ, সমাজতাত্ত্বিত গবেষণা এবং তথ্য সংগ্রহে গুরুত্বারোপ করা। কারণ, সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা এআইয়ের সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করতে পারে, যা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নীতি ও কৌশল নির্ধারণে সহায়ক হবে।

সপ্তম, জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৫০.৪৩ শতাংশ নারী এবং শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২ অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বেকার নারীর সংখ্যা ৯ লাখ ৪০ হাজার। অর্থাৎ এআই প্রযুক্তি বাস্তবায়নে জেন্ডার ইনক্লুসিভিটি নিশ্চিত করতে হবে।

অষ্টম, এআই-সম্পর্কিত শিল্পগুলোতে নতুন সুযোগ তৈরি করতে সামাজিক উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তাকে উত্সাহিত করতে হবে, যা কর্মশক্তি যথাযথভাবে কাজে লাগাতে সহায়ক হবে।

দেশের সার্বিক উন্নয়নে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা নিশ্চিত করতে ব্যক্তি, সরকার, উদ্যোক্তা, সুশীল সমাজ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও আন্তর্জাতিক অংশীদারসহ সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

আর এ ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে এআইসহ অন্যান্য প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার, সুশীল সমাজ এবং অন্য স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে এআই নীতি এবং এর বাস্তবায়ন পরিবর্তনশীল বিশ্বে টিকে থাকার জন্য আবশ্যিক, সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ এবং জনসংখ্যার প্রয়োজনের প্রতি ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল।

তথ্যসূত্র:
১. জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২২
২. বিবিএস, শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২
৩. জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল
৪. ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম
৫. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

  • লেখক: খাদিজা খাতুন, শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।