দেবীর পূজা নাকি সুহৃদ অর্চনা

সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় যাঁরা মনপ্রাণ ঢেলে দেনছবি: লেখক

আমার কথা শুনে ও কিছুটা হন্তদন্ত হয়ে উঠল। এতক্ষণ উপুড় হয়ে অতিথিদের তালিকা দেখছিল। আমন্ত্রণ শেষে কেউ কি বাদ পড়ে গেছেন! ওর নাম আকাশ। পাশে অভীক। ওদের দুজনের সঙ্গেই কথা হচ্ছিল। এখনো কি আগের মতো আহসানউল্লাহ হল লনে ফোটে গাঁদা, হাসনাহেনা, রজনীগন্ধা, গোলাপ! একসময় খুব যত্নে ফুলগাছ লাগানো হতো এখানে। দেখতে পেলাম ফোটে। সবুজ ঘাসগুলো এখনো জ্বলজ্বল করে। ওরা বলে, বাগানের মালিরা কাজটি করেন বিশেষ যত্ন নিয়ে।

এরই মধ্যে জড়ো হলো বেশ কয়জন।

পাঞ্জাবি পরা ওরা সবাই। বাণী অর্চনার আরতির পর্যায়। আমি শুনি কে কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ে। আলাপ জমে ওঠে। একসময় ওরা টিনের ছাপরার ওই ঘরে দারুণ এক আবেশে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। ক্যামেরার ক্লিকে বন্দী হলো আগামী দিনের একদল প্রকৌশলী।

আমরা ওদিন পাঁচজন এক জায়গায় মিলেছিলাম। সঙ্গে আমাদের পরিবার-পরিজন। আহসানউল্লাহ হলের প্রবেশপথে ছবি তুললাম আমার মেয়ের, সঙ্গে তারই মা। এগিয়ে যাই সোজা পূজা প্রাঙ্গণে। দেখি এক পাশে আড্ডা চলছে আমারই সতীর্থদের।

শ্যামল ঘোষ এগিয়ে এল। পরিচয় করিয়ে দিল তারই প্রাণপুত্রের সঙ্গে। আমি বুকে নিয়ে আদর করি। কুশল ঘোষ এখন কম্পিউটার সায়েন্স প্রকৌশলী। অ্যানিমেশনের ওপর কাজ করছে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশযাত্রার প্রস্তুতি চলছে তার। বলি, শাবাশ বাবা!

একদিন তাঁরা পাঁচজনই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন
ছবি: লেখক

গৌরী শংকর ভট্টাচার্য বেঞ্চে বসা। আমরা একই ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ছিলাম। পাশে তার সহধর্মিণী অর্পণা দেবী। অভিনন্দন জানালাম তাঁকে। রত্নগর্ভা তিনি। এক মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকৌশলী। অন্যজন কানাডায় প্রকৌশলবিদ্যায় পড়ছে। লাকি হালদার উল্কা গল্প করছেন। তাঁরও ইঞ্জিনিয়ার মেয়ে কানাডায় চাকরি করছে। আর ছোটজন দেশে পড়ছে, সেও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী। মেয়েদের খাদ্যাভ্যাস আর পোশাক নিয়ে আলাপ করছিলেন দুই গর্বিত মা।

বিমল রায় সফল ব্যবসায়ী। পাশে বসা ডলি রায়। এই দম্পতির মেয়েও পড়ে প্রকৌশলবিদ্যায়। অর্চিকে আমি চিনি। মেধার চকচকে মুখটি মনে পড়ে।

দেব প্রসাদ রায় আমাদের মিষ্টি বন্ধু। তার আলাপ একটু ভিন্ন ধরনের। সেই কথায় আসে অন্য মাত্রা। আগে ছিল কপোত-কপোতী নিয়ে। এখন তা দম্পতি ধরে। সেকালের বন্ধু মাহাবুব আমাদের মধ্যে। সে তখন সময়ের আলাপচারিতা উপভোগ করছিল।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে, রাজহাঁসের পিঠে চেপে আসেন বিদ্যার দেবী। তিনি জ্ঞানের আলো ছড়াতে এক বছর পরপর আসেন এই পৃথিবীতে। আর মাঘ মাসের শুক্লাপঞ্চমী তিথিতেই বিদ্যালাভের জন্য সরস্বতীর আরাধনা করে সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা।

সহ-উপাচার্যের সঙ্গে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির পূজারিরা
ছবি: লেখক

‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যা কমললোচনে

বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে’

বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসসংলগ্ন আমাদের বাসভবন। মেয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়েছে। আমরা তাকে নিয়েই শামিল পূজা প্যান্ডেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের মুক্ত অঙ্গনকে বেছে নেওয়া হয়েছে এ জন্য। অঞ্জলি শুরু হয়ে যায়। পৌরোহিত্য করে বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী ও ত্রিদিব চক্রবর্তী। তারা দুজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান উপদেষ্টা সাবেক উপাচার্য ফরাস উদ্দিন আহমেদ এসেছেন। ছিলেন সহ-উপচার্য মো. আশিক মোসাদ্দেক। বক্তব্য দিলেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোষাধ্যক্ষ এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী। মানবসভ্যতার উন্নয়নের ধারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ‘শিক্ষা’, বললেন তিনি। প্রাচীন বিহার ময়নামতি কিংবা নালন্দার মতো শিক্ষাঙ্গন আমাদের ঐতিহ্য। ভারত মহাদেশে বিজ্ঞানচর্চা এনে দেয় মানুষের জন্য অভূতপূর্ব সম্মান। এ ছাড়া সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। কী সুন্দর করে কথাগুলো বললেন এই বিদ্বান। যেন ছন্দে ছন্দে শুনি সেই বাণী। সরস্বতী মায়ের হাতের বীণা সংগীতবিদ্যার প্রতীক। মনের ভাব প্রকাশ পায় ভাষায় আর প্রাণের ভাব সুরে। সুরের লহরি সবাই শুনতে চায়।

মুগ্ধতা সঞ্চালকদের কণ্ঠে। অদিতি রায় গানের মতো করে বললেন কথাগুলো। শুভ পালের কণ্ঠও অতুলনীয়। ধরিত্রী দে, পিউ মণ্ডল পরবর্তী সময় দুধে চিনির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন। উদ্‌যাপন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক অভিষেক বিশ্বাস। ১৩তম অনুষ্ঠান এটা। শিক্ষার্থীদের অর্থায়নে চলছে সেই শুরু থেকে, জানালেন তিনি। অভিষেক ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ধন্যবাদ জানালাম।

জয়শ্রী সরকার এল প্রসাদ নিয়ে। লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমাদের হাতে তুলে দিল বাণী অর্চনার প্রসাদ।

আমরা মুগ্ধতা প্রকাশ করলাম। অনিক সাহা কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। এবার পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। বললেন, দুস্থ ছেলেমেয়েদের সাহায্য দানের মধ্য দিয়ে তাঁদের এ যাত্রা। জানালেন, প্রতিবছরই গরিব শিক্ষার্থীদের বই দেওয়া হয় বাণী অর্চনার খাত থেকে। সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ রায় তাঁর তৃপ্তি প্রকাশ করলেন। সফলতার সঙ্গে অনুষ্ঠান আয়োজন সমাপ্তির দিকে যাচ্ছে বলে পরবর্তী পর্বের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগের আহ্বান জানালেন তিনি।

এর আগে ভিড়ের মধ্যে দূর্বা নিজেই প্রসাদের প্যাকেজ নিয়ে এল। খিদের কাছে কিসের আপস! তার এ উদ্যোগের প্রশংসা করি। বলি, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এমন করে লড়তে হবে। মিটমিট করে হাসেন পাশের এক তরুণী মা। গল্প শুনিয়েছি তাকে। কানাডার ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনের আয়োজনে গিয়েছিলাম, সে আমার জ্যেষ্ঠ মেয়ের কল্যাণে অভিভাবক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে। বিশ্বের একদল পণ্ডিতের বক্তব্য শুনলাম। মূল কথা একটাই, ‘তোমার যা প্রাপ্য, লড়ে নিতে হবে, বুঝে নিতে হবে।’ এ শিক্ষাই দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। আবার তরুণী মায়ের নিঃশব্দ হাসি।

শুরু করেছিলাম তীর্থস্থান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। পুরোনো দিনে ফিরে যাই। সদলবল যাই আহসানউল্লাহ ক্যানটিনে। সেই জিলাপি, পেঁয়াজু, সেই সেদ্ধ ছোলা। খাওয়া উপলক্ষ। কথা লাখ লাখ।

সেই ৩৫ পয়সার পরোটা, ৫০ পয়সার সবজির ঘ্রাণ এখনো শরীরে জড়িয়ে। রাতে হালকা চালের খিচুড়ি। আমি বলি, অল্প দামের এই যে টিফিন, এর–ও আছে এক আবেদন। অপর্ণা দেবী যোগ করেন, এ যে প্রাণের টান, মনের তৃপ্তি।

আবার বসি মণ্ডপ চত্বরে। শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার মঞ্চ সাজাচ্ছিলেন। এরই মধ্যেই কথা হলো বাণী অর্চনার আয়োজন পর্ষদের সভাপতি সনজু বসাকের সঙ্গে। শেষ বর্ষের ছাত্র বলে এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শেষ আয়োজন। সবাইকে এক জায়গায় আনতে পারার আনন্দ প্রকাশ করলেন। সাধারণ সম্পাদক পার্থ কুণ্ডুও ছিলেন পাশে। আপ্যায়নের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়, জানালেন তিনি। আমি আমার ভালোবাসা জানালাম।

মঞ্চে কুশীলবেরা।

কথা হলো অনন্যা চৌধুরীর সঙ্গে। গানের মেয়ে। রামিসা তাঁর সঙ্গে। এর আগে কথা হয়েছে তাঁদেরই সুহৃদ তৃতীয় বর্ষের সুবর্ণা বিথির সঙ্গে। বললেন, ক্লাস এগোনোর সঙ্গে চাপ বেড়েছে। আনন্দও বেড়েছে পূজায়। উপভোগ হয়ে গেছে এখন ব্যবস্থানির্ভর। কী করবেন, কোনটা বাদ দেবেন?

তাঁদের আরেক বন্ধু দূর্বাকেও তাঁদের সঙ্গে যুক্ত করলেন। আবার ক্লিক।

আমরা বিদায় নিলাম। মনের মধ্যে কেমন যেন এক শূন্যতার অনুভূতি! সে কি হারানোর, নাকি কোনো কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার!