প্রখর ব্যক্তিত্বের একজন আধুনিক ও রঙিন মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই
প্রখর ব্যক্তিত্বের একজন আধুনিক ও রঙিন মানুষ হয়ে বাঁচতে চাই।
কী করে?
নিজের ভেতর জমে থাকা সব নেতিবাচক ভাবনা, দূষিত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নিজেকে সহজ মানুষ করে তুলি। যা কিছু মন্দ, যা কিছু বেদনা জাগায়, সেসব কিছুকে ভাসিয়ে দিই ওই দূর আকাশে মেঘেদের ভেলায়।
আমাদের সবার ভেতরেই কিছু নেতিবাচক ভাবনা ঘাপটি মেরে থাকে, যা আমরা বুঝতেই পারি না। তাই না বুঝেই অনেক সময় অন্যদের দুঃখ দিয়ে ফেলি। আমরা আমাদের অবস্থান, যোগ্যতা, শিক্ষা, টাকা এমনকি রূপ নিয়েও অহংকার করি। সাফল্যের জোয়ারে আমরা আমাদের অন্তরের সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলি। যখন যোগ্যতার চেয়ে প্রাপ্তিটা বেশি হয়ে যায় অথবা সেই প্রাপ্তির ভার বহন করার শক্তি হারিয়ে ফেলি, তখন আমরা ধরাকে সরা জ্ঞান করি। মানুষকে আর মানুষ বলে মনে হয় না।
ছোটবেলায় নজরুলের কবিতায় পড়েছিলাম, ‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে দেখব এবার জগৎটাকে।’ সেই জগৎ দেখতে গিয়ে টের পাচ্ছি লেখাপড়া জানা মানুষও কতটা নীচ আর অসাধু হতে পারে। অহংকার মানুষকে পতনের দিকে নিয়ে যায়। অহংকারী মানুষকে স্বয়ং বিধাতাও পছন্দ করেন না। কিন্তু আমরা সব ভুলে যাই, শুধু মনে রাখি নিজের সুখ-সমৃদ্ধির কথা।
জীবন খুব ছোট। তাই যতটুকু সময় বাঁচি, সেই বেঁচে থাকাটুকু যেন আনন্দের হয়, অন্যের জন্য নিবেদিত হয়, তেমন করে নিজেকে তৈরি করা। তোমাকে দেখে যেন মানুষ তোমার কাছে যেতে ভয় না পায়। নিজেকে এমন সহজ আর মানবিক মানুষ করে গড়ে তোলো, যেন নিমেষেই লোকে তোমার খুব কাছে আসতে পারে। গা ঘেঁষে বসতে পারে।
কিন্তু না, আমরা যখনই কিছু একটা অর্জন করে ফেলি, সেই সঙ্গে বিসর্জন দিয়ে দিই আমাদের বিবেক ও মনুষ্যত্ববোধ। মানুষের সত্যিকার মূল্যায়ন তার মানবিকতায়, পেশাগত যোগ্যতায় নয়। অহংকার, লোভ, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা—এসব নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য মানুষকে একেবারে অসাড় করে দেয়। ন্যূনতম বিচারবোধ তার আর থাকে না।
জীবন আমার কাছে পদ্মপাতার জলের মতো—এই আছে এই নেই। অনেকটা আবার ড্যাফোডিল ফুলের মতো। তাই জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই তাকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো উচিত। অহংকার, লোভ, হিংসা—এসব মানুষকে কেবল ধ্বংসের দিকেই নিয়ে যায়। ভালো কোনো ফল বয়ে আনে না। অথচ আমরা বোকার মতো অহংবোধ নিয়ে বাঁচি।
একটা গল্প বলি।
নার্সিসাস ফুলের নাম হয়তো আমরা অনেকেই জানি। নার্সিসাসকে বলা হয় আত্মপ্রেমের প্রতীক। নার্সিসাস ছিল অপূর্ব সুন্দর এবং আকর্ষণীয় এক তরুণ। সে তার নিজের সৌন্দর্যকে দারুণ ভালোবাসত। পরিরা তাকে খুব পছন্দ করত। তার কাছে আসতে চাইত। কিন্তু নার্সিসাস ছিল বেজায় অহংকারী এক যুবক। সে সবাইকে তার অযোগ্য ভাবত।
একদিন নার্সিসাস শিকার করে বাড়ি ফিরছিল। পথিমধ্যে ইকো নামের এক পরি তাকে দেখে তার প্রেমে পড়ে যায়। ইকো কথা বলতে পারত না। কিন্তু প্রতিধ্বনি তৈরি করতে পারত। প্রতিধ্বনির মাধ্যমে সে নার্সিসাসকে বোঝানোর চেষ্টা করল যে নার্সিসাসকে সে ভালোবাসে এবং চায়। কিন্তু অহংকারী নার্সিসাস সব বুঝেও অন্যদের মতো ইকোকেও প্রত্যাখ্যান করল।
অভিমানে কষ্টে ইকো পাহাড়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি তৈরি করতে থাকে এবং একপর্যায়ে ইকো আত্মহত্যা করে।
নার্সিসাসের এই নিষ্ঠুর আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধের দেবী নামোসিস তাকে একটি শিক্ষা দেওয়ার চিন্তা করে। এমন শাস্তি দিতে হবে যেন, সে কোনো দিন কারও ভালোবাসা না পায়।
নেমোসিস একদিন নার্সিসাসকে শিকারে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে নার্সিসাসের ভীষণ তৃষ্ণা পায়। সে তৃষ্ণা মেটাতে নদীতে যায় পানি পান করতে। নদীর পানিতে নার্সিসাস নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায়।
নিজের এমন অনিন্দ্যসুন্দর প্রতিচ্ছবি দেখে নার্সিসাস নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে যায়। প্রতিচ্ছবি ধরতে গিয়েও ধরতে পারে না সে।
এই প্রথম কাউকে ভালো লাগে তার। সে তাকে মনেপ্রাণে পেতে চায়। কিন্তু কোথাও তাকে পায় না। বনে বনে খুঁজে বেড়ায় সেই জলের ভেতর দেখা নিজেরই প্রতিচ্ছবি।
দুঃখে কষ্টে নার্সিসাস খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দেয় এবং প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। একটা সময় তার শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং সব সৌন্দর্য ম্লান হতে থাকে। শারীরিক অসুস্থতায় ভুগতে ভুগতে নার্সিসাস মৃত্যুবরণ করে। মাটির সঙ্গে মিশে যায় তার দেহাংশ। আর সেই মাটি থেকেই জন্ম হয় নার্সিসাস ফুলের।
আসলে প্রকৃত সৌন্দর্যের যেমন বিনাশ হয় না, তেমনি কখনো কখনো অতি অহংকারও মানুষকে মাটিতে মিলিয়ে দেয়।
এই যে নার্সিসাসের এত রূপের অহংকার ছিল, সেই অতীব অহংকারই কিন্তু তাকে পতনের দিকে নিয়ে যায়। নিয়ে যেতে যেতে মৃত্যুর কাছে পৌঁছে দেয়।
কত কিছু নিয়ে আমাদের অহংকার। আগেই বলেছি টাকার অহংকার, ক্ষমতার অহংকার, শিক্ষার অহংকার, সাফল্যের অহংকার এমনকি ঈশ্বরপ্রদত্ত রূপেরও অহংকার।
নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা সব ক্রোধ, ক্ষোভ, অহংবোধ ঝেড়ে ফেলুন। নিজেকে অন্যদের কাছে অনুসরণীয় করে গড়ে তুলুন। এই যে মাদার তেরেসা, নেলসন ম্যান্ডেলা, এপিজে আব্দুল কালাম—এদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরিচিতি; এঁদের আলাদা করে কোনো উপমা দিতে হয় না। তাই তো শ্লোকে বলে, ‘চেনা বামুনের পৈতা লাগে না।’
আমরা ক্রমশ আমাদের বিবেকবোধ হারিয়ে ফেলছি, নীতি–নৈতিকতা বিসর্জন দিচ্ছি। কিন্তু কেন? কিসের লোভে কিসের আশায়? আমরা এতটাই হিংস্র হয়ে উঠছি যে ভুলে যাচ্ছি পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধ। অথচ বাঙালি নাকি আবেগপ্রবণ জাতি। কোথায় সে আবেগ, কোথায় সে মানবতা?
আমরা শুধু ঘোড়ার রেসের মতো দৌড়াচ্ছি কিন্তু কোথায় থামব, সে গন্তব্য জানি না। আর এতটাই মোহ–মাদকতায় ব্যস্ত থাকছি যে অনেক সময় নিজের সন্তানের বড় হওয়ার মতো প্রাকৃতিক পরিবর্তনটুকুও টের পাচ্ছি না।
আমরা আসলে ভীষণ স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছি। আমার তো মনে হয় আমরা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ খারাপ থাকি শুধু অন্যের ভালো থাকার কথা ভাবতে ভাবতে।
আসুন, নিজের মতো করে বাঁচি। ঈশ্বর যতটুকু দিয়েছেন, যা দিয়েছেন, তাই নিয়ে ভালো থাকি।
জীবনানন্দের কবিতার মতো পাখি হয়ে দোয়েল হয়ে ফড়িং হয়ে প্রজাপতি হয়ে বাঁচি। নিশ্চিন্ত জীবন বলে কিছু হয় না। অতিরিক্ত কিছু পেতে গিয়ে যদি আত্মসম্মান এবং মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দিতে হয়, তাহলে আর সে জীবনের সত্যিকার অর্থ কি বলুন?
সত্যিকার মানুষ বাঁচে মেরুদণ্ড সোজা করে মাথা উঁচিয়ে।
*লেখক: রোজিনা রাখী, ফিচার লেখক
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]