সখিনা বেগম: বীরের বন্দনা করি

কিশোরগঞ্জের নারী মুক্তিযোদ্ধা সখিনা বেগম মারা গেছেন। ছবিটি বাজিতপুর উপজেলার হিলচিয়ার বড়মাইপাড়া এলাকায় চলতি বছরের মার্চ মাসে তোলাছবি: প্রথম আলো

স্বাধীনতার অগ্নিস্নাত ইতিহাসে যাঁরা নিজেদের রক্ত, ঘাম, সাহস ও ভালোবাসা দিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটির স্বরূপ, তাঁদের একজন ছিলেন সখিনা বেগম। আজ আমরা সেই জননী সাহসিকার চিরপ্রস্থান সংবাদে নতশির হই। মঙ্গলবার, ভোর পাঁচটায় বার্ধক্যজনিত কারণে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার হিলচিয়ার বড়মাইপাড়ায় শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সখিনা বেগম। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বীর মুক্তিযোদ্ধা সখিনা বেগমকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন, নিকলী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেহানা মজুমদার।

বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তাঁর প্রয়াণে নিভে গেল এক দগ্ধ, দীপ্ত মশাল -যার আলোতে একদিন পথ দেখেছিল মুক্তিকামী এক জাতি।

প্রথম আলো জানাচ্ছে, নিকলীর হাওরপাড়ের গ্রাম গুরুই ছিল সখিনার জন্মভূমি। দেশ ছিল তাঁর একমাত্র সন্তান। স্বামী কিতাব আলী মুক্তিযুদ্ধের আগেই মারা গিয়েছিলেন। সন্তানহীন এই নারী একাত্তরে শুধু নিজের জীবন নয়, নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন জন্মভূমির জন্য। অংশ নিয়েছিলেন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে। সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন তাঁরই ভাগনে মতিউর রহমান। নিজেও ছিলেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি। কিন্তু ভয়ের সঙ্গে যার কখনো সম্পর্কই ছিল না, সেই সখিনা একদিন পালিয়ে এলেন বন্দিদশা থেকে -সঙ্গে করে নিয়ে এলেন এক ধারালো দা, যা পরে হয়ে উঠল এক নির্ভীক প্রতিশোধের প্রতীক। সেই দা দিয়েই তিনি কুপিয়ে হত্যা করেছিলেন নিকলীর স্বাধীনতাবিরোধী পাঁচ রাজাকারকে।

সেই দা সংরক্ষিত আছে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। নামফলকে খোদাই হয়ে আছে অমর নাম ‘সখিনা বেগম’। অস্ত্র সবসময় বারুদের ধোঁয়ায় কথা বলে না, কখনো কখনো সেটা রাঁধুনি নারীর হাতের ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে বিজয় চিহ্ন। সখিনা ছিলেন এমন এক সাহসিনী, যিনি যুদ্ধকালীন রন্ধনশালাকে রণাঙ্গনে রূপ দিয়েছেন, রান্নার ফাঁকে সংগ্রহ করেছেন শত্রুর খবর, রন্ধনের পাশে দাঁড়িয়ে রচনা করেছেন রণকৌশলের নতুন পাতা।

এই দেশের মাটিতে আজ যত স্বাধীন নিঃশ্বাস, বিজয়ীর মঙ্গল করতল, তা শুধু পুরুষ যোদ্ধার একার নয় -সখিনা বেগমের মতো অসংখ্য নির্ভীক নারীর সর্বস্ব ত্যাগ ও সাহসেই তা বিনির্মিত। বদলে যাওয়া বর্তমান সময় রাজাকারের নাম নিতে সংকোচ বোধ করে, ইতিহাসকে চেপে ধরার চেষ্টা চলে প্রাতিষ্ঠানিক নীরবতায়। সেখানে সখিনা বেগম রেখে গেলেন এক তীক্ষ্ণ দা, যা শুধু শত্রুকে নিপাতের স্মারক হয়ে ওঠে না, আমাদের ঘুমন্ত বিবেককেও জাগিয়ে তোলে মহত্তম মহিমায়।

তাঁর মৃত্যু শোকের নয়, বরং চির মর্যাদার।

তাঁর জীবন কোনো গৃহবন্দি নিঃসঙ্গতার গল্প নয়, এক জাতির মুক্তির মহাকাব্য। তাঁর সাহসিকতা শুধু অতীতের গৌরব নয়, ভবিষ্যতের জন্য চেতনার দীপশিখা। চিরজাগরূক থাকুন এই বীরজয়া। আপনার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি শ্বাস, প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশ নামক স্বপ্নের এক একটি শক্তপোক্ত পোড়খাওয়া ইট হয়ে থাকবে। আপনার মতো বীরের বন্দনা করি সশ্রদ্ধ চিত্তে!

সখিনা বেগম, আমাদের কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে -আপনার আত্মার চিরশান্তি কামনা করি।

আপনি বেঁচে থাকবেন প্রতিটি সাহসী নারীর চোখে,

প্রতিটি স্বাধীন বাঙালির হৃদয়ে।

লেখক: সাংবাদিক