জীবন বোধ থেকেই মনোবিজ্ঞান অধ্যয়ন জরুরি

বর্তমান যুগ আধুনিক বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান প্রকৃতিকে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। একসময় প্রকৃতির যেসব বিষয় আমাদের কাছে খুবই রহস্যপূর্ণ ছিল, সেগুলোর সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বিজ্ঞান আমাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমরা দৈনন্দিন নানা সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হই। আর আমাদের এসব সমস্যার ভিন্নতা ভেদে বিজ্ঞানেরও কিছু আলাদা সুপ্রতিষ্ঠিত শাখা গড়ে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে বিজ্ঞানের সর্বশেষ সুপ্রতিষ্ঠিত শাখাটির নাম হলো মনোবিজ্ঞান। পদার্থবিদ্যা যেমন প্রকৃতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, রসায়ন বিভিন্ন মৌলের পারস্পরিক পরিবর্তন এবং জীববিজ্ঞান শারীরতত্ত্বের ওপর কাজ করে, ঠিক তেমনি মনোবিজ্ঞান মানুষ ও প্রাণীর আচরণ এবং মানসিক প্রক্রিয়া সম্বন্ধে অনুধ্যান করে থাকে।

তবে অনেকেরই মনোবিজ্ঞান সম্বন্ধে ভুল ধারণা রয়েছে। তাদের ধারণা, মনোবিজ্ঞানের কাজ শুধু মন নিয়ে এবং মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের মুখ দেখেই তার মনের কথা বলে দিতে পারেন। তারা হয়তো জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে এটা জানে না, মনোবিজ্ঞান অনুমাননির্ভর কিছু বলে না। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতোও এটা যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে পরীক্ষা ও গবেষণামূলক একটি বিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞানের ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘psychology’। গ্রিক শব্দ ‘psyche’ এবং ‘logos’ থেকে ‘psychology’ শব্দের সৃষ্টি হয়েছে। ‘psyche’ অর্থ ‘আত্মা’ এবং ‘logos’ শব্দটির অর্থ ‘জ্ঞান’।

এখানে মনোবিজ্ঞানের সার্থক নামকরণ থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এটি আত্মা উদ্ভূত বিভিন্ন উদ্দীপনা, যাকে আমরা সাধারণ ভাষায় আচার-আচরণ বলে থাকি, সে সম্বন্ধে পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন ঘটনার সাপেক্ষে পর্যবেক্ষণমূলক একটি বিজ্ঞান।

বর্তমানে এটি বিজ্ঞানের সুপ্রতিষ্ঠিত একটি শাখা হলেও উনিশ শতকের আগে মন-সম্পর্কীয় সব অধ্যয়ন দর্শনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। দার্শনিকেরা মানসিক আচার-আচরণ বা ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে কেবল অনুমান করেছিলেন। মন সম্পর্কে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো প্রথম ব্যাখ্যা করেন। তিনি মনকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে গণ্য করেন। প্রথমে মনোবিজ্ঞানকে আত্মার বিজ্ঞান, পরে মন ও চেতনার বিজ্ঞান এবং বর্তমান কালে আচরণের বিজ্ঞান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এভাবে মনোবিজ্ঞানের ক্রমবিকাশে বর্তমানে এটি একটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান হিসেবে স্থান অর্জন করে নিয়েছে। আর এর পেছনে উইলহেম উন্ড, উইলিয়াম জেমস, সিগমুন্ড ফ্রয়েডসহ বহু মনোবিজ্ঞানীর নিরলস প্রচেষ্টা রয়েছে। বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে আধুনিক মনোবিজ্ঞানের প্রসার হচ্ছে।

একজন মানুষকে নিজের জন্য হলেও মনোবিজ্ঞানের অন্তত প্রাথমিক পাঠটুকু নেওয়া দরকার। আমাদের জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি কার্যকলাপের ওপর আমাদের আচরণের প্রভাব রয়েছে। আমরা দৈনন্দিন জীবনে যেসব আচার-আচরণ করে থাকি, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা, পর্যবেক্ষণ এবং তার সম্ভাব্য ফলাফলগুলো মনোবিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে জানা যায়। তা ছাড়া আমরা মনোবিজ্ঞান অধ্যয়ন করে মানুষের মানসিক প্রক্রিয়া এবং আচরণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে পারি। এটি মানুষের মনের কার্যকলাপ, সংগতি, বিচ্ছিন্নতা, অনুভূতি ও মানসিক সমস্যার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান প্রদান করে।

মনোবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজের ক্ষেত্র হলো মানসিক বৈকল্যতা, অর্থাৎ অস্বাভাবিক আচার-আচরণ নিয়ে। চারপাশে তাকালে আমরা এই বিষয় খেয়াল করতে পারি যে কিছু মানুষের আচার-আচরণ অস্বাভাবিক, অর্থাৎ মানসিকভাবে তারা বিকারগ্রস্ত। এই যে সমাজে যারা মানসিক বৈকল্যের শিকার, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সেবার জন্য আমাদের মনোবিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানীদের দ্বারস্থ হতে হয়। কেননা, সমাজের বড় একটা অংশকে উপেক্ষা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর এ জন্য মনোবিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসার অবশ্যই প্রয়োজন।

তা ছাড়া মনোবিজ্ঞান ব্যক্তি, সমাজ, সর্বোপরি রাষ্ট্রের কল্যাণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এর জন্য মনোবিজ্ঞানের কিছু আলাদা আলাদা শাখা গড়ে উঠেছে। যেমন ক্লিনিক্যাল মনোবিজ্ঞান, কাউন্সেলিং মনোবিজ্ঞান, ব্যক্তিত্ব মনোবিজ্ঞান, সামাজিক মনোবিজ্ঞান, শিল্প মনোবিজ্ঞান, পরিবেশগত মনোবিজ্ঞান, স্বাস্থ্য মনোবিজ্ঞান, জৈব মনোবিজ্ঞান, উন্নয়নমূলক মনোবিজ্ঞানসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ শাখা ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ফলে আমাদের জীবনযাত্রা আরও অনেক সহজ হয়ে উঠেছে।

মনোবিজ্ঞানকে জীবনঘনিষ্ঠ একটা বিজ্ঞানও বলা চলে। এটি সরাসরি মানুষকে নিয়ে কাজ করে। মানুষের আচার-আচরণের ইতিবাচক ও নেতিবাচকতার পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণ করে ব্যক্তির সব সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানুষের দৈনন্দিন আচার-আচরণ ও কার্যকলাপের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে এটি আমাদের জীবনবোধকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। মানুষের আচরণ যে কত রহস্যমূলক, সেই রহস্যলোকে পৌঁছিয়ে দিয়ে এবং তার সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করে মনোবিজ্ঞান আমাদের ভিন্ন দৃষ্টিকোণে জীবনকে বুঝতে শেখায়। আর এ জন্য শুধু শিক্ষার্থী হিসেবে নয়, একজন সমৃদ্ধ মানসিক ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য অবশ্যই আমাদের মনোবিজ্ঞান অধ্যয়ন করা জরুরি।

*লেখক: রিপন আল মাইন, শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা