এসি বিলাস ও পরিবেশ কর
এসির দাম এখন সাধারণ মানুষের অতি নাগালে। ৫০ হাজার টাকার মধ্যে ভালো ব্র্যান্ডের এসি পাওয়া যায়। দুঃসহ গরমে অনেকের মতো আমার পরিবারের সদস্যদের দাবি ঘরে এসি লাগানোর। অফিসের অনেক জুনিয়র কলিগ বাসায় এসি লাগিয়েছে। শুধু একটি ভাবনার জন্য আমি সিদ্ধান্ত নিতে পরিনি। কেননা, এসিতে আমাদের ঘর ঠান্ডা হলেও তা অন্যের ঘরে গরম বৃদ্ধির কারণ হবে।
এসির অত্যন্ত ক্ষতিকর দিক হলো সিএফসি গ্যাস নিঃসরণ করা। যা ওজোনস্তর ধ্বংস করাসহ বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক। শীতলীকরণের জন্য এসি ও ফ্রিজে যে রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস ব্যবহার করা হয়, সেটি প্রথম আসে ১৯৩০–এর দশকে। তখন থেকে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (সিএফসি) নামের এই রাসায়নিক ফ্রেয়ন বাতাসে ছড়িয়ে ওজোনস্তরের ক্ষতি করে চলেছে। এ গ্যাস ব্যবহার হয় হিমকারক যন্ত্রে (এসি, রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজ প্রভৃতি) ফোম শিল্পে, খাদ্য সংরক্ষণ, প্রসাধনী, কীটনাশক উৎপাদনে। গ্রিন হাউজ প্রভাব সৃষ্টিতে সিএফসির ভূমিকা প্রায় ১৬ শতাংশ। ১৯৮৭ সালের একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে সিএফসি গ্যাস উৎপাদন নিষিদ্ধ করা হয়। বর্তমানে নিষিদ্ধ সিএফসির বদলে হাইড্রোফ্লোরো কার্বন (এইচএফসি) ব্যবহার করা হচ্ছে। এ গ্যাস ওজোন স্তরের ক্ষতি না করলেও বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। তা কার্বন ডাই–অক্সাইডের তুলনায় ১৪ গুণ বেশি ভূমিকা রাখছে।
আমাদের বেশিরভাগের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা নেই বললেই চলে। টাকা আছে ইচ্ছামতো বাড়ি ও গাড়িতে এসির ব্যবহার করছে। এরকম পরিবেশ বিধ্বংসী প্রবণতা রোধ করতে এবং একই সঙ্গে পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য পরিবেশ কর আরোপ করা প্রয়োজন। পরিবেশ কর, ইকোট্যাক্স বা সবুজ কর হলো এমন একটি কর, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচিত এবং অর্থনৈতিক প্রণোদনার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ক্রিয়াকলাপগুলোকে উন্নীত করার উদ্দেশ্যে ধার্য করা হয়। পরিবেশ ধ্বংসের জন্য দায়ী প্রতিটি কাজের জন্য পরিবেশ কর প্রযোজ্য হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এনভারমেন্টাল ট্যাক্স, কার্বন ট্যাক্স ইত্যাদির প্রচলন রয়েছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (ওইসিডি) এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে দেশের মোট রাজস্ব আয়ে পরিবেশ করের অবদান গ্রিস ১০%, দক্ষিণ কোরিয়া ১১%, তুরস্ক ১১%, ক্রোয়েশিয়া ১১%, সার্বিয়া ১২%, কেনিয়া ১৩%, উগান্ডা, ১৫%, সিয়েরা লিওন ১৬%, ভারত ১৭%, সলোমান দ্বীপপুঞ্জ ২০%। সেখানে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.০১%।
আমাদের দেশেও বিলাসিতার জন্য ব্যবহার্য সামগ্রী যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, তার প্রতিটি ইউনিটের জন্য বার্ষিক পরিবেশ কর আরোপ করা প্রয়োজন। পরিবেশ রক্ষা এবং উন্নয়নে ব্যয়ের চাহিদার ভিত্তিতে পরিবেশ করের হার নির্ধারণ করতে হবে। বৃক্ষ রোপণ, বনায়ন, নদ-নদী রক্ষা ইত্যাদির জন্য পরিবেশ করের অর্থ ব্যয় করতে হবে। সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এ দায়িত্ব পালন করতে পারে। তারা কর আদায়ের পদ্ধতি এবং ব্যবহারের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করবেন।
অনেকেই হয়তো পরিবেশ করের বিরোধিতা করতে পারেন। কিন্তু এটিই হবে সবচেয়ে যৌক্তিক ও ভারসাম্যপূর্ণ কর ব্যবস্থা। টাকা থাকলেই যে কেউ ইচ্ছামতো পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে না। পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধি করে কিছু মানুষ এসির বাতাসে আরামে ঘুমাবে আর বাকিরা নির্ঘুম রাত কাটাবে, তা হতে পারে না। যিনি পরিবেশের ক্ষতিসাধন করবেন, তাঁকেই ক্ষতি পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়ি, গাড়ি, কারখানা ও অফিস-আদালতে যত এসির ব্যবহার হবে, সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিটি এসির সাইজ অনুসারে নির্ধারিত ট্যাক্স আদায় করার মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতিরোধ করতে হবে। এটা কোনো পরিবেশবাদী কিংবা সামাজিক আন্দোলন নয়। এটা হোক সবার আন্দোলন। টেকসই উন্নয়ন সেটাই, যে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিবেশের ক্ষতি করে না, কিংবা বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটানোতে ঘাটতি বা বাধার কোনো কারণ হয় না। এখন আনুমানিক ৫ শতাংশ মানুষ এসি ব্যবহার করে। এ হার দ্রুত বর্ধমান। এ অবস্থাতেই পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা বৃদ্ধি ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত দিচ্ছে। বিদ্যুতের ঘাটতি জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলছে। কিছু মানুষের বিলাসিতার কারণে সারা দেশের মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে। এ সব কিছুর বিবেচনায় পরিবেশ কর আদায় এবং পরিবেশ রক্ষা প্রকল্প পারে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে। নিজেদের বিলাসিতা যাতে অন্যের যন্ত্রণার কারণ না হয়, সে সচেতনতা সবার থাকা চাই।