বন্ধুর বাবার মৃত্যু খবরে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মায়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম। এই একজন মানুষের সঙ্গে আমার প্রতিনিয়ত কথা হয়। সে সময় করে আমার খোঁজখবর রাখে। খেলাম কি খেলাম না, এসব প্রতিনিয়ত জবাবদিহি করতে হয়। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় মা বলছিল, ‘বাবা, খেয়েছ? কী করলা আজ? ইউনিভার্সিটি গিয়েছ? কয়টা ক্লাস হলো? পরীক্ষা কবে? সুস্থ আছ?’ আরও অনেক প্রশ্ন করতে থাকল মা। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে থাকা অবস্থায় আমাকে ফোন দিল আমার বন্ধু শাকিল। আমি মায়ের ফোন কেটে দিয়ে কারোর ফোন সাধারণত রিসিভ করি না। সেদিন কেন জানি শাকিলের ফোন রিসিভ করলাম। মাকে বললাম, তোমাকে একটু পরই ফোন দিচ্ছি। আমি মাকে তুমি করেই বলি। কেউ এটাকে অভদ্রতা বলতে পারেন, কিন্তু আমি মাকে ভালোবাসি বলে তুমি বলি। ফোন রিসিভ করামাত্র শাকিল আমাকে বলল, ‘তারিফের আব্বা মারা গেছে নাকি শুনলাম। তুই একটু সিওর হয়ে নে তো মারা গেছে কি না।’ আমি তারিফকে ফোন দিলাম, কিন্তু তারিফের ফোন বন্ধ।

আমি পাঁচ–ছয় মাস আগে প্রথম তারিফের বাসা গিয়েছিলাম। ওদের বাসা ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলায়। আমি মোটামুটি কয়েক বন্ধুকে ফোন দিলাম যে আসলেই ঘটনা সত্য কি না। কিছুক্ষণ পরই নিশ্চিত হলাম যে আসলেই তিনি মারা গেছেন। আমার ক্লাসমেট কিছু বন্ধু তারিফকে এবং ওর চাচাতো ভাই আর ফুফাতো বোনকে বাসে তুলে দিল। কেননা তিনজনই রাজশাহীতে থাকে। আমরা কয়েকজন বন্ধু একত্র হয়ে প্ল্যানিং করতে থাকলাম যে ঝিনাইদহতে আমরা যাব এবং জানাজায় শরিক হব। কিন্তু রাজশাহী থেকে ঝিনাইদহ ট্রেনে গেলে সকালে যেতে হবে আর রাতে কোনো ট্রেনও নেই যে আমরা রাতেই পৌঁছাতে পারব। আমাদের রাতেই যেতে হবে ওখানে, কেননা জানাজা হবে বেলা সাড়ে ১১টায়। আমরা রাতের খাবার মতিহার হলের ক্যানটিনে খেয়ে নিলাম। খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

কয়েকজন বন্ধু আবার বলল, ‘আরে মামা দেখ অনেক পথ যেতে হবে। তা–ও রাতে! কীভাবে যাবি? আবেগ দিয়ে ভাবলে হবে না, বিবেক দিয়ে ভাব।’ আমি বললাম এসব কোনো বিষয় না; আমি ওদের বাসায় গিয়েছি কয়েক মাস আগে। যদিও প্রথমবার যেয়ে সে রকম কিছু চেনা যায় না রাস্তাঘাটের, তবে আমার ফোনে গুগল ম্যাপে তারিফের বাসার লোকেশন ছিল। আমি কোথাও গেলে লোকেশন স্ক্রিনশট করে রাখি ফোনে। আমার আরেক বন্ধু, শান্ত ও বলল আরে সমস্যা নেই; আমার কাছে ফোন আর টাকা থাকলে আমি কখনোই হারিয়ে যাব না। ফোন থেকে স্ক্রিনশট বের করে দেখালাম তারিফদের বাসা নেপা উপজেলায়। আমরা সবাই (আমি, শাকিল, শান্ত, মোজাহিদ, জাহাঙ্গীর, আসিফ, হাবীব ও আমিরুল) মতিহার হল থেকে রওনা হলাম কাজলা গেটে। কাজলা গেটে কিছু বাস আছে, ওখানে জিজ্ঞেস করলাম, বাসের ভাড়া কত করে, কিন্তু দাম বেশ বেশি বললেন। আমাদের মধ্যে সবাই বলতে থাকল, চলো বাসস্ট্যান্ডে যাই। ওখানে বাসে ওঠব। গেলাম বাসস্ট্যান্ড। কাউন্টারে জিজ্ঞেস করার পর দেখলাম বাস আছে এবং টিকিটের দাম একটু কম। সে জন্য আটটা টিকিট কেটে নিল শান্ত। এদিকে আমি আর আসিফ বাসে যেতে পারি না, বমি করে ফেলি। আমরা দুজন ওষুধ কিনে নিলাম। বাস ছাড়ল ৯টা ৩০–এর কয়েক মিনিট পরই। বাসে উঠে ওষুধ খেয়ে নিলাম। বাস চলছে। কেউ ঘুমিয়ে গেল, আসলে কেউ ঘুমিয়ে যায়নি, চোখ বন্ধ করে ছিল।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমি কয়েক মাস আগে তারিফদের বাসায় প্রথম গিয়েছিলাম। ওর আব্বা অনেক ভালো মানুষ। আমি বাসে বসে চোখ বন্ধ করে ভাবছি, সবাইকে একদিন মরে যেতে হবে। আঙ্কেল কত ভালো মানুষ ছিলেন, তা কীভাবে ভাষায় প্রকাশ করব? উনি আমাকে প্রায় সময় ফোন দিয়ে বলতেন ‘আব্বা, কেমন আছ? শরীর সুস্থ আছে আব্বা? উনি সবাইকে মধুর সুরে ডাকতেন। ‘সোনা, ময়না, পাখি’ এসব শব্দ ব্যবহার করতেন ভালোবেসে। একজন মানুষ আপনার সঙ্গে তাঁর কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই, অথচ তিনি আপনাকে এ রকম সুমধুর সুরে ডাকেন? কতটা ভালো মানুষ তিনি? এসব আমি ভেবেই যাচ্ছি বাসে বসে থেকে আর বাস চলছে। আমার বাকি বন্ধুরা সে সময় কে কী ভাবছিল তা জানি না বলে সেসব বলতে পারলাম না। বাস আমাদের নামিয়ে দিল কালীগঞ্জে। ঝিনাইদহের একটি উপজেলা। তবে আমাদের যেতে হবে মহেশপুর জেলার নেপা ইউনিয়নে। রাত গভীর। বাস থেকে নেমে আরেকটি বাস পেলাম। ওই বাসে উঠে চলে গেলাম নেপা বাজার। বাজারে নেমে চা খেলাম আমরা সবাই। কেননা সারা রাত ভ্রমণ, ঘুম নেই। মাথাব্যথা করছিল। বাজারে জিজ্ঞেস করলাম তারিফের আব্বার নাম। তাতে স্থানীয় লোকেরা চিনে ফেললেন এবং একটি ভ্যান ঠিক করে দিলেন। ভ্যানে চড়ে ওদের বাসায় গেলাম। বাসায় কান্নাকাটি, মানুষেরা নিস্তব্ধ। আমরা তারিফদের বাসায় পৌঁছানোর একটু পর ফজরের আজান দিল। বাসার পাশের মসজিদে সবাই নামাজ পড়লাম। সকাল হয়ে গেল। সবাই কান্নাকাটি করছেন।

তারিফের মেজ ভাই, বড় ভাই ও ওর আম্মা কান্নাকাটি করছে। তারিফের জ্বর, ও কাঁদছে। গা কাঁপছে ওর। আমার বাকি বন্ধুরা ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমি পারছি না। কারণ, যার প্রিয়জন চলে যায়, সে বোঝে এর ব্যথা। জানাজার সময় চলে এল। এখন লাশ নিয়ে যেতে হবে। প্রিয়জনদের কান্না, কেউ যেন শেষবিদায় দিতে চাচ্ছে না। মাদ্রাসার মাঠে জানাজা হলো। অনেক মানুষ এসেছেন জানাজায়। মেম্বার, চেয়ারম্যান, হাফেজ, মাওলানা, শিক্ষকসহ অনেক মানুষের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন আঙ্কেল। জানাজায় তারিফের মেজ ভাই পড়ালেন। তারপর বাসার পাশের মসজিদের কবরে দাফন হয়ে গেল। সবাই এলাম তারিফদের বাসায়।

তারিফকে বন্ধুরা মিলে ভাত খাওয়ালাম। তারিফের মেজ ভাই, আন্টি এবং তারিফকে সান্ত্বনা দিয়ে রওনা দেব ক্যাম্পাসে; এমন সময় তারিফের চাচা আমাদের নিয়ে গেলেন উনাদের বাসায় এবং দুপুরে খাওয়ালেন। সেখান থেকে আবার আমাদের ডিপার্টমেন্টের এক বড় ভাইয়ের বাসা কাছে ছিল; উনি উনার বাসায় নিয়ে গেলেন। আমরা ট্রেনের টিকিট কেটে ফেললাম অনলাইনে। বিকেলবেলা রওনা হলাম দর্শনা হল্ট স্টেনের অভিমুখে। ট্রেন ৪০ মিনিট দেরিতে এল। ট্রেনে উঠে সবাই সবার সিটে বসে পড়া এবং ট্রেন ছাড়ার কয়েক মিনিটে সবার ক্লান্ত চোখ বন্ধ হয়ে গেল। কয়েক ঘণ্টা পর চলে এলাম রাজশাহী স্টেশন এবং সেখান থেকে ক্যাম্পাসে। এভাবেই বন্ধুর বাবার জানাজায় শরিক হলাম আমরা আট বন্ধু। কিছুদিন পর বন্ধু ক্যাম্পাসে এসে বলল, ‘তোরা আমার এলাকার মানুষের কাছে ইউনিভার্সিটির বন্ধুত্বের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে দিয়েছিস।’ সবশেষে চাওয়া, আল্লাহ আঙ্কেলকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। পরিবারকে শক্ত হওয়া এবং শোক কাটানোর তৌফিক দিন।

*লেখক: ইসমাইল হোসেন ইমরান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]