যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের কত্ত ভালোবাসা!
কত্ত ভালোবাসা! ‘আমরা তাইওয়ানকে কখনোই ছেড়ে যাব না।’ ইমোশনালি হোক, বা যেকোনো মাত্রার ফিলিংয়েই হোক অথবা আবেগ, আসক্তিতে হোক, যেমনটি সব বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড পরস্পরকে বলে থাকে, ‘আমি তোমাকে ছেড়ে যাবে না’। ইউক্রেনের সঙ্গে ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘লাভ লাভ’ সম্পর্ক। এখনো ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়েনি। তবে রাশিয়ার মতো পরাশক্তির মাসের পর মাস ক্ষেপণাস্ত্রসহ সর্বাধুনিক আকাশপথের হামলায় ইউক্রেনের রাস্তাঘাট, বাড়ি-স্থাপনা আজ ‘তামা’ বনে যাচ্ছে! যুক্তরাষ্ট্রের এ ভালোবাসা সাদ্দামের সঙ্গেও ছিল, গাদ্দাফির সঙ্গেও ছিল, একসময় ছিল লাদেনের সঙ্গেও, ’৭১-এ পাকিস্তানের সঙ্গেও ছিল। যুক্তরাষ্ট্র এমনই এক বন্ধু কারোরই সর্বশেষ পরিণতি না দেখে ছাড়েনি। এ জন্য বহুল প্রচলিত প্রবাদ, যা না বললেই নয়, ‘আমেরিকা যার বন্ধু, তার আর শত্রু লাগে না।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি ২ আগস্ট তাইওয়ান সফরকালে বলেছেন, ‘কখনোই তাইওয়ানকে ছেড়ে যাবে না যুক্তরাষ্ট্র’ (ধ্বংস হওয়ার আগপর্যন্ত!!)। এর চেয়ে বড় জোকস আর কী আর হতে পারে...!
ইউক্রেনের পরিণতি থেকেও কি তাইওয়ানের শিক্ষা হবে না? যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে মাঠ বানিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে খেলছে। এবার হয়তো তাইওয়ানকে মাঠ বানিয়ে চীনের সঙ্গে খেলবে। খেলোয়াড় ঠিকই থাকবে, মাঠ শুধু তলিয়ে যাবে! যুক্তরাষ্ট্র অন্যের হয়ে খেলে। সরাসরি রাশিয়া, চীনের সঙ্গে খেলবে না। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি খুবই জটিল, যা বোঝা বড় দায়। শান্ত পৃথিবীকে অশান্ত করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার অন্যতম লক্ষ্য। বাস্তবে তারা যুদ্ধ কখনো জড়াবে না, বিপরীতে অন্যকে জড়িয়ে দেয়। যাতে দ্বিতীয় রাষ্ট্রকে অর্থনৈতিকভাবে কাবু করে ওই রাষ্ট্রের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারে। তাইওয়ান মোটামুটি একটি উন্নত ও পরিচ্ছন্ন দেশ। চীনের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র এক ঢিলে কয়েকটি পাখি মেরে ফেলবে বলে বিশ্বাস করে। তাইওয়ানের কাছে কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি করবে! অন্যদিকে চীন যুদ্ধে জড়ানোর কারণে অর্থনীতির চাপে পড়বে!
বিশ্বের বেশির ভাগ যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা প্রভাবিত। তাইওয়ানকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে আমেরিকান অর্থনীতি অস্ত্র বিক্রির ওপর নির্ভর করে। এটি তাদের ব্যবসা। গত বছর তাইওয়ানের কাছে প্রায় ১৮০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাবে সম্মতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। যার মধ্যে রয়েছে এফ সিক্সটিন যুদ্ধবিমানের সেন্সর, মিসাইল, রকেট লঞ্চারসহ অত্যাধুনিক রণ সরঞ্জাম। সবশেষ তাইপেকে প্রায় ২৫০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। নতুন এই অস্ত্রগুলো দিয়ে যুদ্ধজাহাজ, বিমান, সাবমেরিন ধ্বংস করা সম্ভব বলে জানায় ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এই অস্ত্রের সাহায্যে তাইওয়ান তাদের উপকূল রক্ষা করতে পারবে। আরও যুদ্ধ মানে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য আরও আয়, যুক্তরাষ্ট্রের আরও উন্নত অর্থনীতি।
চীন আর তাইওয়ানের দ্বন্দ্ব নতুন নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের স্পিকারের তাইওয়ান সফর নিছক একটা রাজনৈতিক খেলা। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘ পরিকল্পনা নিয়ে আগায়, আবেগে নয়। সুবিধাভোগী যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যেভাবে দাবার ঘুঁটি বানিয়েছে, ঠিক তেমনি তাইওয়ানকেও বানাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, সামরিক শক্তিতে সমৃদ্ধ একটি দেশের সঙ্গে (চীন) কীভাবে তাইওয়ানের মতো একটি ছোট দেশের যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিল? কার ভরসায় তাইওয়ান যুদ্ধে জড়াবে? ইউক্রেনের মতো যুক্তরাষ্ট্র তথা ন্যাটোর ভরসায়?
দক্ষিণ চীন সাগরের স্বশাসিত ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানকে নিয়ে চীনের দাবিদাওয়া নতুন কোনো ব্যাপার নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই তাইওয়ানকে চীন নিজেদের অংশ বলেই দাবি করে এসেছে। অন্যদিকে তাইওয়ানের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক সহযোগী চীন। গত বছর দুই দেশের মধ্যে ব্যবসার পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার। চীনের বর্তমান ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি দাবি করে, তারা কখনোই তাইওয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করেনি; বরং সব সময় তাইওয়ানের স্বশাসিত গণতন্ত্রকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছে। মধ্যখানে প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের মধ্যে ঝামেলা করছে যুক্তরাষ্ট্র। অথচ যুক্তরাষ্ট্র কখনোই তার প্রতিবেশী কানাডা, মেক্সিকোর সঙ্গে ঝগড়া, ঝামেলা করে না। কিন্তু অন্যান্য প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যেমন ভারত, পাকিস্তান, চীন, তাইওয়ান, সৌদি, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, তুরস্ক, আফগানিস্তান, রাশিয়া, ইউক্রেন এদের যুক্তরাষ্ট্র কখনোই মিলেমিশে থাকতে দেবে না। নানা কূটকৌশলে এসব রাষ্ট্রের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে রাখে। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে পাশে থাকার কথা বলে উসকে দিয়ে দেশটি এখন দুনিয়ার নরকে পরিণত হয়েছে! পৃথিবীর যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের পা পরে, সেখানেই অশান্তি! সেটা মধ্যপ্রাচ্য হোক বা দূরপ্রাচ্য।
আফগানিস্তান নিয়ে মুসলমানেরা ভাবতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় হয়েছে। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র মাত্র তাদের মিশন সম্পন্ন করেছে। এতে তাদের জানমালের কতটুকু ব্যয় হবে, সে পরিসংখ্যান মুসলমানের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভালো বোঝে। আরেকটি বিষয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, রাশিয়া—এরা সর্বদাই মুসলিমবিরোধী। এ জন্য মুসলমান দেশগুলোর উচিত হবে এখনই শক্তিশালী জোট গঠন করা। তা না হলে, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন, ইরান, ইরাক আফগানিস্তানের মতো দেশগুলো পশ্চিমাদের জুলুম, নির্যাতন থেকে কখনো রক্ষা পাবে না, অন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ভবিষ্যৎ এমন পরিণতি ঘটবে।
যুক্তরাষ্ট্রের মূল পররাষ্ট্রনীতি হলো বিশ্বে যুদ্ধ সৃষ্টি করা এবং এর থেকে সুবিধা নেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো অস্ত্র ব্যবসা। তাইওয়ানের বোঝা উচিত, চীনের সঙ্গে ঝামেলা করলে তাদেরই বেশি ক্ষতি হবে। চীনেরও অনেক ক্ষতি হবে। ক্ষতি হবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর। লাভ হবে যুক্তরাষ্ট্রের। করোনার ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই লাগিয়ে দিল ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ। যার খেসারত দিচ্ছেন মধ্যম ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো। এখন আবার উসকানি দিচ্ছে তাইওয়ানকে চীনের সঙ্গে লাগার জন্য। তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে আমরা সমর্থন করছি। কথার কথা, তাইওয়ান হচ্ছে চীনের মার পেটের ভাই। আর যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে মাসির পেটের ভাই। মার জ্বলে না মাসির জ্বলে...। তাইওয়ান চীনের প্রতিবেশী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ভাড়া করার পরিণতি ভালো হবে না। কয়েক দিন আগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপে সি চিন পিং বাইডেনকে তাইওয়ান প্রসঙ্গে হুমকি দিয়ে বলেছেন, আগুন নিয়ে তাঁরা যেন না খেলেন, এতে তাঁরা পুড়ে যাবেন।
ওয়াশিংটন তাইওয়ানকে ছেড়ে যাবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন তাইপে সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। ৩ আগস্ট তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। পেলোসি বলেন, ‘আজ আমাদের প্রতিনিধিদল তাইওয়ানে এসেছে দ্ব্যর্থহীনভাবে এটা স্পষ্ট করে দিতে যে আমরা তাইওয়ানের প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি ত্যাগ করব না। আমিও এ প্রতিনিধিদলের একজন গর্বিত সদস্য। আমরা আমাদের স্থায়ী বন্ধুত্বের জন্য গর্বিত।’ তিনি বলেন, ‘এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তাইওয়ানের প্রতি আমেরিকার সংহতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর আমরা আজ সেই বার্তাটিই এখানে নিয়ে এসেছি।’ তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইংওয়েনের সঙ্গে বৈঠকে পেলোসি বলেন, যখন আইনপ্রণেতারা ১৯৭৯ সালে ‘তাইওয়ান সম্পর্ক আইন’ পাস করেছিলেন, তখনই তাইওয়ানের পাশে সব সময় দাঁড়ানোর নীতিগত অঙ্গীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আইনটি দ্বীপটির আত্মরক্ষায় সহযোগিতা করা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক করেছে। তাইওয়ানের প্রতি ‘অবিচল সমর্থন’ জানানোয় পেলোসির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইংওয়েন। তিনি মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকারকে দ্বীপটির সবচেয়ে ‘নিষ্ঠাবান বন্ধুদের’ একজন অভিহিত করেন।
চীনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি তাইওয়ানে সফর করেছেন। সামরিক হুমকি দিয়ে ঠেকাতে না পেরে পেলোসির তাইওয়ান সফরের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে চীন। তাইওয়ানকে নিশানা করে সাঁজোয়া গাড়ি, যুদ্ধবিমান, ট্যাংকের কুচকাওয়াজ চালিছেন সি চিন পিং। চীন পেলোসিকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাইওয়ান এমন কোনো জায়গা নয়, যেখানে তারা চাইলেই সফর করতে পারে। তাইওয়ানের সফরে পেলোসি যে বিমানটি ব্যবহার করেছেন, সেটির রুট দেখে বোঝা যায়, চীনের সামরিক বাহিনী পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) সংশ্লিষ্ট জলসীমায় চলমান সামরিক মহড়া পরিচালনা করার ভয়ে তার বিমানটি দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর দিয়ে উড়ে গিয়েছিল। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, চীনের সামরিক প্রতিরোধব্যবস্থা পেলোসিকে বিপদ অনুভব করতে বাধ্য করেছে। এ ছাড়া পেলোসি যখন তাইওয়ানের দিকে যাচ্ছিলেন, ঠিক তখনই পিএলএর এয়ারফোর্স তাইওয়ান প্রণালি অতিক্রম করার জন্য তাদের এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান পাঠায়। পিএলএর ইস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড আগে থেকেই দ্বীপটির উত্তর, দক্ষিণ-পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যৌথ নৌ ও বিমান মহড়া, তাইওয়ান প্রণালিতে দূরপাল্লার আর্টিলারি শুটিং এবং দ্বীপের পূর্ব দিকে সমুদ্র অঞ্চলে প্রচলিত ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার মহড়ার মাধ্যমে তাইওয়ান দ্বীপের চারপাশে যৌথ সামরিক অভিযান পরিচালনা করে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় শক্তিধর দুই দেশের নেতার মধ্যে যে অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগজনক পরিস্থিতি, তা বাকি বিশ্বের ওপর বিশাল চাপ তৈরি করছে। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে বিশ্ব এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাইডেন ও সি চিনের মধ্যে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্কই হতে পারে বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার পূর্বশর্ত। বাইডেন ও সির মতো ঝানু নেতাদের কাছ থেকে আরও বেশি রাজনৈতিক বিচক্ষণতা বিশ্ব আসা করছে। এশিয়াকে অশান্ত করা চেষ্টা চালাচ্ছে মার্কিন কর্তৃপক্ষ, এমন পরিস্থিতিতে চীনকে ঠান্ডা মাথায় এগোতে হবে, নইলে এশিয়াসহ সারা বিশ্ব এর ভুক্তভোগী হবে। এমনকি দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়তে পারে। আমার মনে হয়, তাইওয়ানের উচিত নয় ইউক্রেনের পথে হাঁটা।