ঝড়ের রাত, টিনের চালে বাতাসের ঝাপটা টের পাচ্ছি। হঠাৎ মেসেঞ্জারে মেসেজের আওয়াজ। বন্ধু শাওন মণ্ডল যোগ করেছে একটি চ্যাট গ্রুপে। স্কুল জীবনের বন্ধুদের গ্রুপ। বড় তনু, শুভঙ্কর, পিয়ালী, মিমসহ সবাই আছে। মেসেজের পর মেসেজ আসছে। আমি কিছু লিখছি না। ওদের কথা পড়তেই ভালো লাগছে। কোনো খেয়ালে ঠিক খেয়াল নেই ‘সবাই মিলে একটা পুনর্মিলনী করলে কেমন হয়!’ লিখে পাঠালাম। গ্রুপের প্রায় সবাই একমত পোষণ করল। পরের দিন ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে এসএসসি ১৪ ব্যাচের পুনর্মিলনীর প্রয়োজনীয় খরচ, তারিখ ও স্থান নির্ধারণ করা হলো। পাশাপাশি আয়োজনে কী কী থাকবে, কে কোথা থেকে, কীভাবে, কোন কাজ করবে লিপিবদ্ধ করা হলো।

আমার আবেগ বেশি। ভেতরে ভেতরে অপেক্ষার যন্ত্রণায় আছি। আয়োজনের দুদিন আগে যন্ত্রণা মিটল।

বাড়ি পৌঁছালাম। তখন প্রথম বর্ষে পড়ি। পড়ালেখার জন্য বন্ধুদের একেকজন দেশের একেক প্রান্তে থাকে। কেউ এসেছে, কেউ আসছে, কেউ আসবে। ‘পিতার খুনি’ শিরোনামের নাটক পুনর্মিলনীর অন্যতম আকর্ষণ। সকাল বিকেল মহড়া চলল। কিন্তু হঠাৎ আকাশের কান্না দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। বৃষ্টি হলে আয়োজন পরিপূর্ণ হবে না। অনেকেই উপস্থিত হতে পারবে না। তাছাড়া প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচের পরিকল্পনাও ভেস্তে যাবে। প্রকৃতি আমাদের আহ্বান শুনল। ১৭ জুন ২০১৮ তারিখে চকচকে রোদ চড়ল আকাশে। সকাল ১০টায় স্কুলসংলগ্ন আবু শারাফ সাদেক মিলনায়তনে ১৪ ব্যাচের প্রথম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের পর্দা উঠল। কারও চোখে জল, কারও মুখে হাসি। স্কুল জীবনে বহুল আলোচিত শব্দগুলো দিয়ে সাজানো টি-শার্টের সামনের অংশ। পেছনে মাইকেল মধূসূদন দত্তের কবিতার লাইন থেকে লেখা ‘...তিষ্ঠ ক্ষণকাল’।

শুরুর আনুষ্ঠানিকতা শেষে ক্রিকেট ম্যাচ শুরু হলো। সবার চোখে মুখে আনন্দ। দুপুরে খাওয়ার সময় শত শত গল্প জেগে উঠল। সবাই একসঙ্গে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গেলাম। কেশবপুর সরকারি পাইলট উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে এসএসসি। নেহাতই কম সময় নয়। প্রাঙ্গণের গাছগুলোও যেন চিনতে পারল। গ্রুপ ছবি উঠানো হলো।

দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে, মিলনায়তনে গেলাম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনার জন্য মাইক্রোফোন হাতে নিতেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম। সুরে সুরে খালি গলাই গেয়ে উঠলাম, ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।’ স্মৃতিচারণা পর্বে অনেকেই কথা বলল। কত গল্প, কত স্মৃতি সবার। ‘পিতার খুনি’ মঞ্চস্থ হতেই মিলনায়তন করতালিতে মুখরিত হলো। তন্ময় পাল স্কুল জীবনের নানা ঘটনা নিয়ে সংবাদ উপস্থাপন করল। রিফাত গিটার বাজিয়ে গান শোনাল। দু-একজন রম্য বক্তৃতা করল। জীবনের নানা অনুভূতির কথা শোনাল বন্ধু ইব্রাহিম ও সুস্মিতা পাল। প্রকৃতির নিয়মে ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে সময় ঘনিয়ে এলো, শেষ হলো পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান।

পাঁচ বছর আগের কথা। কিন্তু কি স্পষ্ট মনে আছে সব। মনে আছে, অনুষ্ঠানের সমাপ্তির ঘোষণা দিতেই মনে হয়েছিল, কোথাও যেন একটা কিন্তু রয়ে গেল। সেই কিন্তুটা কি—মায়া, বন্ধুত্ব, স্মৃতি নাকি অন্য কিছু। এত বছর পরও খোঁজ পাইনি। যখনই ভাবি, গোটা স্মৃতিটুকুই অপরূপ মনে হয়।

  • লেখক: সৌমেন্দ্র গোস্বামী, কেশবপুর, যশোর