পৈতৃক সম্পদ‌

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মেয়ে দুটোকে না হয় বিয়ে দিয়ে দিবা, কিন্তু পাঁচ ছেলের মাথা গোঁজার ঠাঁই তো রেখে যাবা! গ্রামবাসী ও আত্মীয়স্বজনেরা বাবাকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। বাবার এক কথা, এক টাকা ঋণ নিয়েও কবরে যেতে চাই না। ছোটখাটো ব্যবসা করতে গিয়ে বাবা বেশ ঋণ করেছিলেন। বাবার সরলতাকে কাজে লাগিয়ে সুদখোর কিছু মানুষ প্রতি মাসে লাখে ১০ হাজার টাকা লাভ নিত। এমন‌ও হয়েছে, কারও কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে দুই বছরে ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন; কিন্তু এখনো সেই ২০ হাজার টাকা পাওনা। ১৯৯৯ সালে প্রায় পাঁচ লাখ টাকায় সব জমি বিক্রি করে ঋণ শোধ করা হলো।

বাবা আমাদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারল না; কিছু না, মানে কিছুই না!

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শুরু করলাম টিউশনি। মাসিক আয় আমার ভাবনার চেয়েও বেশি। সব খরচ করে বাকি টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিতাম; শর্ত ছিল বাবার কোনো ব্যবসা করা যাবে না, নামাজ এবং তাবলিগ নিয়ে থাকতে হবে। সেই টাকায় ছোট ভাইবোনের পড়াশোনা, পাশাপাশি সাংসারিক খরচ চলত। শূন্য থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে আমাদের পরিবার। বাবা সেই টাকাও বেহিসাবি খরচ করত। মানুষকে খাওয়ানো বাবার নেশা ছিল। গ্রামের মসজিদে তাবলিগের মানুষ এসেছে অথচ বাবা একটু ডাল–ভাতের আয়োজন করেনি, এমন কখনো হয়নি। প্রতি মাসে এত টাকা চায়ের বিল আসে, কত‌ চা খাও? ছেলেমেয়ের জন্য তো কিছুই রেখে যেতে পারোনি, ওদের টাকাপয়সা এত নষ্ট করো না, অভিযোগের সুরে বাবাকে মা প্রায়ই বলত। নিকটস্থ বোর্ডঘর বাজারে সাইদুর ভাইয়ের চায়ের দোকান। সেখানে বলে দিয়েছিলাম যেন বাবার চা খেতে কোনো সমস্যা না হয়। বাবার সঙ্গে তাবলিগের সঙ্গীসাথি থাকত। সংগত কারণেই দুই-তিনটার জায়গায় আট-দশটা চা হতো প্রতিদিন। মাস শেষে ২০০-৩০০ কাপ চা!

মাস্টার্সে থিসিস চলাকালে প্রথম চাকরি পরীক্ষা দিয়েই কেমনে জানি চাকরিটা পেয়ে গেলাম। গণিত ও ইংলিশ টিউশনির একটা বেনিফিট সম্ভবত চাকরি পরীক্ষায় পেলাম। বেতনের পুরো টাকা তুলে বাবার হাতে দিতাম। এই অভ্যাসটা আমার ছাত্রজীবনেই গড়ে উঠেছিল। মা অবশ্য আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকত। সব টাকা খরচ করে ফেলি; যদি কখনো বিপদ–আপদে টাকার প্রয়োজন হয়?

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৬ দিন ধরে বাবাকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। ‘কোনো দিন টাকাপয়সার বিপদ আসবে না, হুট করেই আল্লাহ তাআলা একদিন নিয়ে যাবে’ তোমার এই কথা কি আল্লাহ শুনত? মা বেডের এক কোনায় বসে আমাকে প্রশ্ন করে। কোনো জবাব খুঁজে পাই না। ক্যানসার, ফুসফুস থেকে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, বাড়িতে নিয়ে যান। রোগী যা যা পছন্দ করে তাই করুন; যা কিছু খেতে চায়, তাই দিন! অনেকটা সিনেমার ডায়ালগের মতো।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ঈদ পর্যন্ত বাবা থাকলেন না। ১৮ রোজার রাতে মাথার ওপর থেকে ছায়াটা সরে গেল। ভোরে যখন পৌঁছালাম, সাহ্‌রি খেয়ে গ্রামের মুরব্বিদের অনেককেই রাস্তায় বা আমাদের বাড়ির কাছাকাছি ছিলেন। সবার ধারণা, মজনু বাড়িতে এলেই আবার কান্নার রোল পড়ে যাবে। মরা মানুষের কাছে সবাই কান্নাকাটি করা মানুষ দেখতে চায়; হাসিখুশি মুখ দেখতে চায় না। আমার কান্না আসছে না। অনেক চেষ্টা করেও কান্না করতে পারলাম না। সারা রাত কাঁদতে কাঁদতে হয়তো চোখের পানি শুকিয়ে গেছে অথবা ভেতরটা পাথর হয়ে গেছে।

ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে ওয়েটিং রুমে বসে আছি। আলট্রাতে যাওয়ার আগে ব‌উ বলে গেল যেন দোয়া করি। ব‌উয়ের ধারণা, তার ছেলেই হবে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে দোয়া করত ছেলে হ‌ওয়ার জন্য। আমাকে বললেও পাত্তা দিতাম না। দুই মেয়েকে নিয়ে তো আলহামদুলিল্লাহ সুখে আছি। তৃতীয়টাও মেয়ে হলে ‘তিন কন্যা’ উপন্যাস লেখার চিন্তাভাবনাও গুছিয়ে নিচ্ছি। ব‌উ, বিষাদ বদনে বের হয়ে এসে মোবাইল চাচ্ছে। তার শাশুড়ি মাকে কল দেবে; নিজের মাকে না। অপর প্রান্ত থেকে রিসিভ হতেই ব‌উ হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। মা, আপনি না বলেছিলেন আপনার ছেলে তার বাবাকে খুব ভালোবাসত, খুব মান্য করত; ওর বাবা আসবে, ও আবার বাবা ডাকার মানুষ পেয়েছে। ১৮ সালের ১৮ রোজার পর ছোট মেয়েটাকে আর কখনো মা ডাকা হয়নি। সব সময় বাবা বলে ডাকতাম। আমার ছেলেকে বাবা বলে ডাকতে পারব ভেবে কাঁদলাম কি না জানি না।

ব‌উ কদিন ধরেই কেনাকাটার জন্য তাগিদ দিচ্ছে। দুজনের বোনাসের পুরো টাকা দিয়ে সাধ্যমতো চেষ্টা করি প্রিয় মানুষগুলোর জন্য কিছু করতে। ফাইয়াজের এবার প্রথম ঈদ। বাবার ঈদ বলে কথা! আচ্ছা ফাইয়াজের কেনাকাটায় কেন বাবার কেনাকাটার কথা মনে পড়ে? সেই পায়জামা-পাঞ্জাবি! সাইদুর ভাইয়ের চায়ের দোকানে এখনো মানুষের ভিড় জমে; কিন্তু বাবাকে সেই ভিড় ঠেলে খুঁজে পাই না। চাইলেও সেই দোকানে গিয়ে বলা হয় না ‘এই মাসে বিল কত হয়েছে’?

বাবা কিছুই রেখে যেতে পারোনি; এটা কখনোই মনে হয়নি। আমার কাছেও কোনো মানুষের এক টাকা ঋণ‌ নেই বাবা। এমনকি বাসার নিচে যে বড় শপ থেকে মাসের কেনাকাটা করি, সেই শপে কখনো টাকা শর্ট পড়লে মালিকের অনুরোধ উপেক্ষা করে বাসা থেকে এসে টাকা নিয়ে যাই। আমিও ঋণ নিয়ে মরতে চাই না বাবা। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে যখন মুরব্বিদের মুখে শুনি তোমার মতো ভালো মানুষ আমাদের সমাজে খুব কম ছিল, তখন নিজেকে সম্পদশালী মনে হয় বাবা; পৈতৃক সম্পদ!

ভালো থেকো বাবা। মাথার ওপর তোমার ছায়াটা খুব বেশি মিস করি!

* মোহাম্মদ মজনু মিয়া, মুখ্য কর্মকর্তা, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক