ফিলিস্তিনের দুঃখ ঘুচবে আর কবে?

ইসরায়েলের হামলায় সন্তান হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন গাজার এই নারী। গাজা সিটি, ফিলিস্তিন, ১৯ জুনছবি: রয়টার্স

কাল যখন খবর পেলাম যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে—আশায় বুক বেঁধেছিলাম; এবার বুঝি বিশ্ব সমাজ নড়েচড়ে বসবে। অথচ আজ সকালে বিবিসি বাংলা ‘বিস্ফোরক লৌহ দানব’- গাজায় আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ইসরায়েলি ‘বুবি-ট্র্যাপ রোবট’ শিরোনামে খবর দিয়েছে।

ওই খবরে বলা হয়েছে, ‘পুরাতন সামরিক যানগুলো বিশাল মোবাইল বোমায় পরিণত করে আবাসিক এলাকার কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করা হয় এবং রিমোটের মাধ্যমে এগুলোর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভবনগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়। ফলে আশপাশের যে কোনো ব্যক্তি কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টুকরা টুকরা হয়ে যায়—এর প্রভাব বিমান হামলার চেয়েও ভয়াবহ এবং ধ্বংসাত্মক। এই মারণাস্ত্র সম্পর্কে বলছিলেন গাজার বাসিন্দা আলম আল-ঘৌল, স্থানীয়রা এটিকে “বুবি-ট্র্যাপ রোবট” বলে বর্ণনা করে থাকে। তারা বলছে, এই প্রথমবারের মতো এমন অস্ত্র দেখছে তারা, যা অতীতে কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতিতেই তারা দেখেনি, খুব ঘন ঘন এগুলো ব্যবহার করে গাজায় আক্রমণ হচ্ছে এখন।’

দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মহল একমাত্র টেকসই সমাধান হিসেবে দেখে আসছে। জাতিসংঘের একাধিক প্রস্তাবে এই সমাধানের উল্লেখ আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনপুষ্ট ইসরায়েল ধারাবাহিকভাবে দখলনীতি চালিয়ে যাওয়ায় বাস্তবে এটি অনেকটাই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। ব্রিটেন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বৃহৎশক্তির স্বীকৃতি এই অচলাবস্থায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করবে।

যুক্তরাষ্ট্র এখনো স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। দেওয়া দরকার এসব দায়সারাগোছের আলোচনা দিয়ে কার্যত ইসরায়েলের সঙ্গে প্রকাশ্য দোস্তি জিইয়ে রাখছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরেও এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্ত ইউরোপীয় পরিসরে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। আয়ারল্যান্ড, স্পেন, নরওয়ে, সুইডেনের মতো দেশ আগেই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ফ্রান্সও খুব সহসাই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে—এমন ঘোষণা দিয়েছে। এখন ব্রিটেনের মতো একটি প্রভাবশালী শক্তি যুক্ত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের একক অবস্থান অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।

ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ হারানো প্রিয়জনের মরদেহ ঘিরে ফিলিস্তিনিদের আহাজারি। গাজা, ফিলিস্তিন, ৭ মে ২০২৫
ছবি: এএফপি

কাগজে–কলমে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বলে কিছু নেই। তবে রাষ্ট্র হিসেবে বহু দেশ এই ভূখণ্ডকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে, বিভিন্ন দেশে এই দেশের কূটনৈতিক মিশনও রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে ফিলিস্তিনের দীর্ঘ সময়ের বিরোধের কারণে ফিলিস্তিনের কোনো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা, রাজধানী বা সেনাবাহিনী নেই।

বিবিসি বাংলার কূটনৈতিক প্রতিনিধি পল অ্যাডামস গতকালই বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ‘পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর বহু বছরের দখলদারত্ব চলার পর ১৯৯০–এর দশকে ‘প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটি’ বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়, যাদের ওই ভূখণ্ড ও সেখানে বসবাসরত মানুষের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। ইসরায়েলের আগ্রাসনে গাজা এখন যুদ্ধক্ষেত্র। কাজেই এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া অনেকটাই প্রতীকী। নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করলে এটি বেশ শক্ত পদক্ষেপ, কিন্তু বাস্তবতা হলো—এই সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি খুব একটা পরিবর্তন হবে না।’

জামিলা সানকারার ছোট ছেলে মাহমুদকে গুলি করার পর তাঁকে নিয়ে যান ইসরায়েলি সেনারা। ছেলের মরদেহ ফিরে পাওয়ার আশায় একটি কবর প্রস্তুত করে দিন গুনছেন জামিলা। বালাতা শরণার্থীশিবির, পশ্চিম তীর, ফিলিস্তিন

হতে পারে এই স্বীকৃতি প্রতীকী, তারপরও দখলদার ইসরায়েল এত দিন ধরে বলে আসছে, ‘ফিলিস্তিন রাষ্ট্র এখনো জন্মায়নি, তাই শান্তি আলোচনাই হলো প্রথম শর্ত।’ আজকের এই স্বীকৃতি সেই যুক্তিকে দুর্বল করে দিল। আন্তর্জাতিক মহলে ইসরায়েলের দখলনীতি ও বসতি সম্প্রসারণ এখন আরও বেশি চাপের মুখে পড়বে। এর মানে, ভবিষ্যতের আলোচনায় ফিলিস্তিন ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে টেবিলে বসতে পারবে, কেবল ‘অঞ্চল’ হিসেবে নয়।

এর ফলে আন্তর্জাতিক চাপ ইসরায়েলকে আলোচনার টেবিলে ফিরতে বাধ্য করতে পারে। কাজেই ব্রিটেন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার স্বীকৃতি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রামে আপাতত একটি কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে ধরতে পারি আমরা। তবে এর সাফল্য নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো কতটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে, আর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন নেতৃত্ব কতটা বাস্তব আলোচনায় অংশ নেবে তার ওপর।

সভ্যতার কতটা অবনমন হলে, মানুষ কতটা নিচে নামলে ফিলিস্তিনবাসীর ওপর এমন নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে! বিশ্বে যারা সভ্যতার ধ্বজাধারী, দেশে দেশে মানবাধিকার রক্ষায় বহু খরচায় বড় বড় সংস্থা লালন করে; সেই তাদের প্রচ্ছন্ন মদত, ছত্রচ্ছায়া ও পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে যুগের পর যুগ ফিলিস্তিনে এমনতর মানবাধিকার লঙ্ঘন চলতে পারে? আমরা একজন মানুষের জীবন বাঁচাতেও যেখানে প্রাণপণ লড়াই করি, সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার, সেখানে সকাল–সন্ধ্যা প্রাণ কেড়ে নেওয়ার মহড়া মানুষ হিসেবে আমাদের দুর্মতি ও নিচুতাকেই প্রকাশ্যে আনে। প্রযুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে ইসরায়েলের অনেক অবদান আছে, সেই তাদের রাজনীতিবিদরা এমন দখলদার কী করে হতে পারে, তা কল্পনারও অতীত। জাতিগত নিধন ও ভূমি দখলে দুর্মর আগ্রাসন জিইয়ে রেখে বিশ্ব বিদ্বৎসমাজ ও সাধারণ মানুষের এমন আগণন ঘৃণা ও নিন্দামন্দ কি কারও অর্জন হওয়া উচিত? এই জীবন আর কত দিনের?

আমরা ফিলিস্তিনি শিশুদের কান্না আর দেখতে চাই না। যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে মুসলিম বিশ্ব একজোট হয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি সংহতি জানাবে এই প্রত্যাশা করি। শতবর্ষ পরে হোক তবু আজকের নৈতিক সমর্থন যদি মজলুম ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা অর্জনে ছিটেফোঁটাও কাজে লাগে, সেটা হতে পারে মানবীয় গুণাবলির শ্রেষ্ঠ স্মারক। সবাই যদি মুক্ত বাতাসে স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারে, ফিলিস্তিনবাসী কেন নয়? নিশ্চয়ই দখলদার ইসরায়েলের বোধোদয় হবে এবং সামনের কোনো একদিন স্বাধীনতার আলপথ বেয়ে হেঁটে যাবে ফিলিস্তিনের মুক্তপ্রাণ দূরন্ত শিশুরা।

ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশের কবিতা ‘অন্যদের কথাও ভাবো’ আমাদেরও সমস্বর উচ্চারণ:

তুমি যখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও —অন্যদের কথাও ভাবো

যারা শান্তি চায় তাদের ভুলে যেয়ো না।

তুমি যখন পানির বিল দিতে যাও —অন্যদের কথাও ভাবো

যাদের পান করার জন্য মেঘ-বৃষ্টি ছাড়া আর উপায় নেই।

তুমি যখন ঘরে ফেরো, তোমার নিজের ঘরে —অন্যদের কথাও ভাবো

যারা ফুটপাতে থাকে তাদের ভুলে যেয়ো না।

তুমি যখন ঘুমাতে যাও আর আকাশের তারা গোনো —অন্যদের কথাও ভাবো

এমন মানুষ তো রয়েছে যাদের ঘুমানোর জায়গা নেই।

লেখক: সাংবাদিক

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]