আজও সত্যিটা বাবাকে বলতে পারিনি
করোনাকাল। হু হু করে বাড়ছে করোনায় সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা। বাড়ি থেকে দূরে থাকি। মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ বলতে মুঠোফোনে কথা বলা ও মেসেঞ্জারে ভিডিও কল। প্রায় ফোন করে রাগারাগি করেন বাবা। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। বন্ধুদের অনেকেই বাড়ি চলে গেছে। আমি কেন যাচ্ছি না, ভালো-মন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে কী হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। উত্তরে কিছু বলি না। চুপ করে থাকি। বাবা বিরক্ত হয়ে ফোন রেখে দেন। আমার জন্য মা-বোনকেও বকা শুনতে হয়। তাঁদের কাছে ক্ষমা চেয়ে বাবাকে কিছু একটা বলে ম্যানেজ করতে বলি।
ক্রান্তিকালীন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও মেসে পড়ে থাকার কারণ বাবাকে জানানো যাবে না। শুনলে কষ্ট পাবেন। বাড়ির সবার জন্য আজীবন অনেক করেছেন। কাকা, পিসি পরিবারের প্রত্যেক মানুষের প্রতি তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। স্কুলজীবন থেকেই টিউশনি করে সংসারের হাল ধরেছেন। বাবা ছিলেন না, বাবার মতো বড় করেছেন ভাই-বোনদের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ হারায়, সুদিন ফেরে। পড়া শেষ করে বাবা চাকরিতে যোগ দেন। আজ যে খুব বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, তা-ও নয়। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবার। শিক্ষক বাবার বেতনটুকুই সম্বল। আমি ও বোন পড়ালেখা করি। আমাদের পড়ালেখার খরচ থেকে পরিবারের যাবতীয় খরচ—সবই বাবার একার ওপর। যদিও মুখ ফুটে বাবা কখনো বলেন না। তবে বুঝতে পারি, বাবার কষ্ট হয়। কিন্তু কী করার, আমাদের সিস্টেমে অধ্যয়নরত অবস্থায় অর্থ উপার্জনের খুব বেশি সুযোগ নেই। দু-একটা সুযোগ যা আছে, তার মধ্যে টিউশনি সহজ হলেও পাওয়া কঠিন। পরিচিতির পরিসর বড় না হলে টিউশনি পাওয়া যায় না। তবে এ ক্ষেত্রে নিয়তি আমার প্রতি প্রসন্ন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কয়েক দিনের মধ্যে টিউশনি পেয়ে যাই। কিন্তু ক্যাম্পাসে আসার আগে বাবা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, ‘টিউশনি করতে গিয়ে সময় নষ্ট করো না। যা খরচ লাগে, আমি দেব। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। যা কষ্ট করার আমি করব।’
তাই কী করব, কী করি ভাবতে ভাবতে হাত খরচের পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতেও এগিয়ে থাকা যাবে ভেবে পড়ানো শুরু করি। কথায় কথায় মা ও বোনকেও কথাটা জানাই। তবে বাবাকে বলতে মানা করি। একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে তিনটা টিউশনি পাই। সপ্তাহে তিন দিন করে সুবিধাজনক সময়ে পড়াই। নিজের পড়ালেখার ক্ষতি হয় না। সব ঠিকঠাকভাবেই এগোচ্ছিল। কিন্তু করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সব ওলট-পালট হয়ে যায়। বাড়ি গেলে টিউশনি থাকবে না। নতুন টিউশনি জোগাড় করা কঠিন।
অন্যদিকে বাড়ি যাওয়ার জন্য বাবার পীড়াপীড়ি। সব মিলিয়ে টালমাটাল অবস্থা। এর মধ্যে এসে পড়ে বিপদের হানা। এক ছাত্রের বাড়িতে করোনা শনাক্ত হয়। স্বাস্থ্যবিধি মেনে পড়াতে গেলেও চিন্তায় চিন্তায় বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়। করোনা হলে যদি মা-বাবার সঙ্গে আর দেখা না হয়, বাবাকে যদি সত্যিটা বলে না যেতে পারি ইত্যাদি ভেবে বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই, কিন্তু গাড়ি চলাচল বন্ধ। এলাকাভিত্তিক বিধিনিষেধ চলছে। বাবাকে জানালে গাড়ি নিয়ে গিয়ে নিয়ে আসেন। আসার সময় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে করোনা টেস্ট করতে দিয়ে আসি। নিয়তির প্রসন্নতায় ফলাফল নেগেটিভ আসে। তারপরও ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন পালন করি। কোয়ারেন্টিন থেকে বেরিয়ে প্রথমে ছুটে যাই বাবার কাছে। বাবা জিজ্ঞাসা করেন, ‘শুধু শুধু ওখানে পড়ে ছিলি কেন?’ বলতে ইচ্ছা করলেও কণ্ঠ দিয়ে শব্দ বেরোই না। বড় হয়ে যাওয়ার বোধ হয় এই এক সমস্যা। জীবনের সবচেয়ে আপন দুজন মানুষ কষ্ট পেতে পারেন ভেবে মনের সব কথা খুলে বলা যায় না। এমনকি কণ্ঠ খুলে বলা যায় না, ‘বাবা, তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।’
লেখক: সৌমেন্দ্র গোস্বামী, কেশবপুর, যশোর
**নাগরিক সংবাদে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]