বিশ্ব নারকেল দিবস পালিত হয় ২ সেপ্টেম্বর। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে মূলত ২ সেপ্টেম্বর এশিয়ান প্যাসিফিক কোকোনাট কমিউনিটির (এপিসিসি) উদ্যোগে দিনটি পালন করা হয়। ভারতসহ মোট ১৮টি দেশ নিয়ে এপিসিসি সংস্থাটি গঠিত। সংস্থাটি মূলত সেসব দেশকে সহায়তা করে এবং নজর রাখে, যেখানে নারকেল উৎপাদিত হয়। ২০০৯ সাল থেকে এপিসিসি প্রতিবছর দিবসটি উদ্যাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। দিবসটির মূল লক্ষ্য—নারকেলশিল্পের উন্নতির মাধ্যমে একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে মজবুত করা।
‘নারকেল’ নামটি পর্তুগিজ শব্দ কোকো থেকে এসেছে, যার অর্থ মাথা বা মাথার খুলি। বলা হয়, এটি ইন্দো-মালয় অঞ্চলের কোথাও উদ্ভূত হয়েছে। নারকেল স্বর্গ বা বেহেশতের ফল। এই বিশ্বাস থেকেই পশ্চিম ফিলিপাইনের আদিবাসীরা নারকেলের পূজা করত। তারাই প্রথম নারকেল চাষ শুরু করে বলে ধারণা করা হয়। জানা যায়, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপের অধিবাসীদের প্রধান খাদ্য ও পানীয় ছিল নারকেল। এমনকি গত শতাব্দীর গোড়ার দিকেও দ্বীপটির মুদ্রাব্যবস্থা ছিল নারকেলনির্ভর। বিশ্বের অনেক দেশেই নারকেল উৎপাদিত হয়। তার মধ্যে ফিজি, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, ব্রাজিল, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন অন্যতম। তবে সবচেয়ে বেশি নারকেল উৎপাদিত হয় ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনে। হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ৭০ শতাংশ নারকেল উৎপাদিত হয় এই তিন দেশে। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ায় সবচেয়ে বেশি নারকেল উৎপাদন হয়ে থাকে। ভারত রয়েছে তৃতীয় স্থানে। নারকেলের চাষাবাদ করে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লাখো মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। আবার ব্যবহার করছে তাদের বিভিন্ন হিন্দুধর্মীয় উৎসবেও। ভারতের বেঙ্গালুরুতে দিবসটি বেশ ঘটা করে পালন করা হয়। এটি তাদের বড় একটি উৎসব। বাংলাদেশে অল্প পরিমাণে হলেও দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে নারকেল উৎপাদিত হয়ে থাকে। দেশের মোট উৎপাদনের ৪০ শতাংশ নারকেল ডাব হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং ৪৫ শতাংশ ঝুনা নারকেল হিসেবে খাওয়া হয়। মাত্র ৯ শতাংশ দিয়ে তেল তৈরি হয় এবং অবশিষ্ট ৬ শতাংশ থেকে চারা তৈরি করা হয়। শ্রীলঙ্কায় বছরে মাথাপিছু নারকেলের ব্যবহার ১৪০টি। আর বাংলাদেশে একজন মানুষ বছরে মাত্র একটি নারকেল ব্যবহার করে। এই হিসাবে বছরে আমাদের প্রয়োজন প্রায় ১৭ কোটি নারিকেল।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু খুলনা শহরের পত্তন হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে গাঙ্গেয় বদ্বীপের ভৈরব ও রূপসা নদীর মিলনস্থলে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে। খুলনা শিল্পনগরী হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে ভৌগোলিক অবস্থান ও স্থানীয় সম্পদ তথা কাঁচামালের সমারোহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নগরীর অনতি দূরে সুন্দরবনের অবস্থানের কারণে বনের সম্পদ আহরণ ও স্থানীয় পর্যায়ে লবণ, পাট, নারকেল, সুপারিনির্ভর ব্যবসা ও শিল্পকে কেন্দ্র করেই শহরটির বিকাশ ঘটে। এর মধ্যে নারকেলশিল্পের প্রভাব কম নয়। নারকেল এ অঞ্চলের অর্থকরী ফল হিসেবে বিবেচিত। নারকেলগাছই বোধ হয় একমাত্র গাছ, যার সব অংশ মূল্যবান এবং তা বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া নারকেল বিভিন্ন গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়। ফলে নারকেলের প্রাচুর্য এই অঞ্চলের সংস্কৃতির ওপর প্রভাব ফেলেছে। নারকেল দিয়ে ঘর ছাউনি থেকে শুরু খুঁটি, বেড়া, সোফা, জাজিম, নানা তৈজসপত্র তৈরির কাজে ব্যবহার হয়। অর্থাৎ খুলনার আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের প্রায় সর্বত্রই নারকেলের প্রভাব লক্ষ করা যায়। এ জন্য এই অঞ্চলের সংস্কৃতিকে নারকেল সংস্কৃতি বললে অত্যুক্তি হবে না।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
বাংলাদেশের সর্বত্রই নারকেল জন্মায়, তবে অধিক পরিমাণে জন্মায় সুন্দরবনের খাড়িমন্ডলে ও নিম্ন জলাভূমি অঞ্চলে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া নারকেল চাষের জন্য উপযোগী। দেশে যেসব জাতের নারকেল চাষ হয়, সেগুলো হলো টিপিকা সবুজ, টিপিকা বাদামি ও দুধে। জাতভেদে প্রতি গাছে ২০০ বা ততোধিক নারকেল পাওয়া যায়। দেশের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, নাটোর, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, চট্টগ্রাম, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর উপকূল অঞ্চলে নারকেল জন্মে। উপকূলীয় দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠেছে বিশাল নারকেলবাগান। যে কারণে দ্বীপটির স্থানীয় নাম হলো নারকেল জিঞ্জিরা। তবে দেশে নারকেল চাষের অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও এর উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কম। এক হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৭ মিলিয়ন নারকেলগাছ রয়েছে এবং প্রায় ৩৯ হাজার হেক্টর জমিতে নারকেল উৎপাদিত হয়। মোট উৎপাদনের পরিমাণ বছরে ৮৯ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন। জানা যায়, ২০০৩ সালে দেশে প্রায় ৫ হাজার ১৯২ জমিতে নারকেল উৎপাদনের পরিমাণ ২ লাখ ৭১ হাজার ১৩৫ মেট্রিক টন। আবার ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে ৫ হাজার ৮২২ একর জমিতে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৫৬৭ মেট্রিক টন নারকেল এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ৯ হাজার ১৫২ একর জমিতে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৮৩৩ মেট্রিক টন নারকেল উৎপাদিত হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে নারকেল উৎপাদন হয় ৫ লাখ ৬ হাজার টন। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ৫০ লাখ ১০ হাজার টন। বস্তুত ২০১৬-১৭ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে নারকেলের উৎপাদন কমতে থাকে। সেই বছর নারিকেলের ফলন ছিল ৬ লাখ ৮৮ হাজার টন।
নারকেল উৎপাদনের হার কম হওয়ার কারণ হতে পারে দক্ষিণ ভারতের মতো দেশে নারকেল তেল রান্নার কাজে ব্যবহার না হওয়া এবং রপ্তানি পণ্য হিসেবে এর চাহিদা গড়ে ওঠেনি। এপিসিসির এক জরিপ প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে ৪০ কোটি নারকেলগাছ লাগানো সম্ভব। কিন্তু উন্নত জাতের নারকেল চারার সন্ধান মেলেনি। কয়েক বছর আগে ভারত ও ভিয়েতনাম থেকে দুটি জাত আনা হলেও হাইব্রিড হওয়ায় তার চারা করা সম্ভব হয়নি।
মাছে-ভাতে যেমন বাঙালি তেমনি বৃহত্তর খুলনার মানুষ আর নারকেল যেন একই সূত্রে গাঁথা। এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের প্রতিটি পর্বে নারকেলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব চোখে পড়ে। এ অঞ্চলের মানুষের ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প-কলকারখানা, জীবনাচার, সামাজিকতা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, পেশার বৈচিত্র্য, ঘরবাড়ির ধরন ও আসবাব, শিক্ষা ও গবেষণা, পর্যটন শিল্প, চিকিৎসা, শিল্প-সাহিত্য, খেলাধুলা, বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারকেলের প্রভাব চোখে পড়ে। জানা যায়, দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে খুলনা বিভাগে নারকেল উৎপাদনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। হিসাব অনুযায়ী ২০১৩-১৪ অর্থবছরে খুলনার ২ হাজার ৮৬২ একর জমিতে ৮৯ হাজার ৪১ মেট্রিক টন নারকেল উৎপাদিত হয়। আবার ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬ হাজার ২৪০ একর জমিতে ৮৭ হাজার ৪৬১ মেট্রিক টন নারকেল উৎপাদিত হয়। এ অঞ্চলে বাড়ির আঙিনায় নারকেলগাছ থাকাকে একধরনের ঐতিহ্য হিসেবে দেখা হয়। এখানকার মানুষ নারকেলগাছ দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করে। এরা নারকেলগাছ দিয়ে লাঠি, হুক্কা, চামচ, কলসির ঢাকনা, বোতাম, গয়না, শোপিস ইত্যাদি তৈরি করে। খুলনার স্থানীয় ভাষায় ‘এক গাছ নারিকেল, দশ গাঁর খরচ চলে।’ এ ধরনের প্রবাদ-প্রবচন নারকেলের উপযোগিতা ও গুরুত্ব বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
পেশা নির্ধারণে
নারকেলকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের অনেক মানুষ তাঁদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। অনেকেই নারকেল–সংশ্লিষ্ট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অনেকে গ্রামের হাটবাজার থেকে নারকেল ক্রয় করে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করে থাকে। এসব নারকেল পরিবহনের সঙ্গে জড়িত রয়েছে অনেক মানুষ। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও নারকেল–সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে জড়িত যেমন নারকেল তেল ও ছোলা মিল কর্মীদের অধিকাংশই বিবাহিত নারী। নারী-পুরুষভেদে মজুরির বৈষম্যও রয়েছে। কর্মরত পুরুষদের বেতন সাধারণত দৈনিক ২৫০-৩৫০ টাকা। পক্ষান্তরে নারী কর্মচারীদের বেতন দৈনিক ২২০-২৭৫ টাকা মাত্র।
ঘরবাড়ি তৈরিতে
কোনো অঞ্চলের ঘড়বাড়ির ধরন নির্ভর করে সে অঞ্চলের আবহাওয়া-জলবায়ু ও প্রাপ্ত কাঁচামালের সহজলভ্যতার ওপর। খুলনা অঞ্চলে ঘরবাড়ি তৈরির উপাদান হিসেবে নারকেলগাছের ব্যবহার চোখে পড়ে। যেমন নারকেলগাছের কাণ্ড দিয়ে ঘরের আড়া, খুঁটি তৈরি করা হয়। আবার নারকেলগাছের তক্তা ঘরের বেড়া, চালের রুয়া, সিলিং বা পাটাতন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া নারকেলপাতা দ্বারা ঘরের ছাউনি, বেড়া ও মাচা তৈরি করা হয়। আবার নারকেলগাছের গুঁড়ি দিয়ে মাটির ঘরের সিঁড়ি তৈরি করা হয়। এ ছাড়া এ অঞ্চলে নারকেলপাতার বেড়া/পর্দার ব্যবহার চোখে পড়ে। আবার নারকেলের ছোবড়া দিয়ে দড়ি, রশি ও কাছি তৈরি করা হয়, যা দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়।
খাবার হিসেবে
দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার তাগিদে নারকেল প্রচুর খাদ্যসম্ভারে সমৃদ্ধ। নারকেল কাঁচা-পাকা দুই অবস্থায়ই খাওয়া যায়। এ অঞ্চলের মানুষ নারকেল দিয়ে বিভিন্ন প্রকার সুস্বাদু খাবার তৈরি করে থাকে। যেমন নারকেলের নাড়ু, সন্দেশ, কুলিপিঠা, ভাপা পিঠা, তালের পিঠা, পোলাও, কোরমা, খিচুড়ি, সেমাই নারকেল, নারকেল-মুড়ি, নারকেল-চিংড়ি, নারকেল-পটোল, নারকেল-কচু, নারকেল-মুরগি, নারকেলের দুধ দিয়ে আমড়া, নারকেলের মালাই, আইসক্রিম ইত্যাদি। আবার কচি নারকেলের সাদা অংশ (শাঁস) অত্যন্ত সুম্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার। নারকেলের শাঁস দিয়ে বিভিন্ন প্রকার পিঠা, মিষ্টি, বিস্কুট, চকলেট তৈরি ও বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া নারকেলের রস দিয়ে গুড় ও তাড়ি (দেশি মদ) তৈরি হয়। এ ছাড়া ডাবের পানি ও নারকেলের ফোপড়া ইত্যাদি সুস্বাদু খাবার হিসেবে স্বীকৃত। এ অঞ্চলে রমজান মাসে ইফতারিতে নারকেল-চিড়া-গুড় বহুল প্রচলিত খাবার। আবার নারকেলগাছের কচি আগা (মাথি) খাওয়ার প্রচলন আছে। আগেকার দিনে এ অঞ্চলে পান্তা ভাতের সঙ্গে গুড় ও নারকেল পরিবেশন করা হতো। আবার নবান্ন বা হালখাতার পায়েস তৈরিতে নারকেল ব্যবহার করা হতো। জানা যায়, কয়েক দশক আগে এ অঞ্চলের অনেক বাড়িতে নারকেল তেল দিয়ে রান্না করা হতো। এ ছাড়া নারকেলগাছের কচি শিকড় পানের সঙ্গে সুপারির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
সামাজিকতায়
এ অঞ্চলের মানুষ সাধারণত কোনো অসুস্থ রোগী দেখতে গেলে সঙ্গে ডাব নিয়ে যায়। ধনী–দরিদ্র নির্বিশেষে বিবাহিত নারীরা বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ি ফেরার সময় নারকেল/ডাব সঙ্গে নেয়। এমনকি এখানে গাছ থেকে নারকেল নামানোর সময় কেউ পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে দু–একটি নারকেল ফ্রি দেয়া হয়। এ অঞ্চলের রীতি অনুযায়ী হিন্দু বিয়ের সময় বরপক্ষ মেয়েপক্ষকে বিশেষ করে মেয়ের মাকে চারটি ডাব উপঢৌকন হিসেবে দিয়ে থাকে। এ ছাড়া ঈদের আগের দিন শহরের ধনীরা গ্রামীণ গরিবদের মধ্যে চাল, চিনি, গুড় ও নারিকেল বিতরণ করে থাকে।
আতিথেয়তায়
খুলনা অঞ্চলের মানুষের আতিথেয়তার অন্যতম উপাদান নারকেল। একসময় এ অঞ্চলে গুরুদক্ষিণা হিসেবে নারকেল প্রদানের প্রচলন ছিল। কারও বাড়িতে ভিন্ন অঞ্চল থেকে কেউ বেড়াতে এলে তাদের নারকেলের তৈরি বিশেষ খাবার পরিবেশন করা হয়। আরেকটি বিষয় হলো, এ অঞ্চলের মানুষ চায়ের বিকল্প হিসেবে অনেকে অতিথিদের ডাবের পানি সরবরাহ করে থাকে।
শিল্পের কাঁচামাল
কোন অঞ্চলে কোন ধরনের শিল্পকলকারখানা গড়ে উঠবে, তা নির্ভর করে ওই অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও কাঁচামালের ওপর। সংগত কারণেই নারকেলকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। এসব মিল কারখানায় তেল, কাতা, দড়ি, ঝাড়ু, চামচ, মশার কয়েল, ব্রাশ, বোতাম, কলমদানি ও বিভিন্ন ধরনের শোপিস তৈরি হয়। নারকেল কারখানায় উপজাত খৈল গরু ও মাছের খাবার ও জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার শুকনো নারকেলের শাঁস থেকে উদ্ভিজ তেল মাথায় ব্যবহার ছাড়াও সাবান, শ্যাম্পু এবং অন্যান্য প্রসাধনসামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। গ্রামের অনেকে চুল পরিষ্কার করার জন্য নারকেলের খৈল ব্যবহার করে থাকে। নারকেলের ছোবড়া দিয়ে একপ্রকার শক্ত দড়ি তৈরি হয়, যা পানিতে ভিজে সহজে পচে না। এ দড়ি জাহাজ ও নৌকায় ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া নারকেলের খোল দিয়ে হুঁকা তৈরি করা হয়।
চিকিৎসায়
নারকেলের রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। যেমন কচি ডাবের পানি খুবই পুষ্টিকর, সুপেয় ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার। এতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম থাকে। যেকোনো ধরনের রোগীর খাবার হিসেবে ডাবের পানির ব্যবহার চোখে পড়ে। ডায়রিয়া রোগের প্রধান খাদ্য হিসেবে ডাবের ব্যবহার দেখা যায়। নারকেলের পানি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায়। তাই অনেক রূপসচেতন শৌখিন নারীরা ডাবের পানি তাদের রূপচর্চার কাজে ব্যবহার করে থাকে। নারকেল তেল চুলপড়া রোধ করে। নারকেলগাছের শিকড়ের রস কৃমিনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আবার অনেকে নারকেলগাছের মূল নেশার জন্য চিবিয়ে থাকে। এ অঞ্চলের মানুষ রোগী দেখতে যাওয়ার সময় হরলিক্স, গ্লুকোজ ও ডাব সঙ্গে নিয়ে থাকে। এ ছাড়া এ অঞ্চলে পচা নারকেল তেল কাটা, পোড়ার প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আসবাব তৈরিতে
আধুনিক জীবনের অনেক শৌখিন উপাদানই নারকেল দ্বারা তৈরি হয়ে থাকে। যেমন সোফা, জাজিম, তোশক, ব্রাশ, ব্যাগ, টুপি, স্যান্ডেল, পাপোশ, কুরুশ, সোফা, গাড়ির সিট, গদি ইত্যাদি তৈরিতে নারকেলের ছোবড়ার ব্যবহারের তুলনা নেই। দেশের সোয়ান, আখতার, পারটেক্স, টাইগারসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ম্যাট্রেজ উৎপাদনে ছোবড়া ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া নারকেলের মালা (খোলস) দিয়ে বিভিন্ন রকমের প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করা হয়। যেমন বাটি, হাতা, বোল, কলমদানি, মোমদানি, লবণদানি, হলুদদানি, চামচ, আসবাবপত্রের ঢাকনা, শৌখিন বোতাম, চাবির রিং, টেবিল ল্যাম্পের স্ট্যান্ড, পাখি, ফুল, হাতিসহ নানা ধরনের দৃষ্টিনন্দন শোপিস। এ ছাড়া নারকেলের ছোবড়া ও শুকনো পাতা দিয়ে মাদুর, কাতা, ঝুড়ি এবং নারকেল শলাকা দিয়ে ঝাড় তৈরি হয়ে থাকে। আবার নারকেলের ছোবড়া হাঁড়িপাতিল-থালাবাসনের মাজনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে
খুলনা অঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবে নারকেলের ব্যবহার চোখে পড়ে। যেমন ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব যেমন ঈদ, শবে বরাত, রোজার সময় নারকেল দ্বারা নানা খাবার তৈরি করা হয়। আবার হিন্দুধর্মাবলম্বীদের উপাসনার অন্যতম উপাদান হলো ডাব ও নারকেল। তারা কচি ডাবে চিত্রাঙ্কান করে পুরোহিতদের প্রদান করে থাকে। বিভিন্ন পূজা ও সামাজিক উৎসবে তারা নারকেলের নাড়ু ও সন্দেশ তৈরি করে থাকে। মুসলিমরা গ্রামাঞ্চলে গাছের প্রথম নারকেল হলে তা মসজিদে দান করা হয়। আবার হিন্দুরা কোনো শুভ কাজ শুরু করার আগে নারকেল ভেঙে থাকে। এ জন্য তারা নারকেলকে শুভ ফল এবং নারকেলগাছকে ভাগ্যবৃক্ষ মনে করে। এ অঞ্চলে একটি সংস্কার প্রচলিত আছে, তা হলো নারকেলগাছ লাগালে পুত্রসন্তান মারা যায়।
যোগাযোগব্যবস্থায়
যোগাযোগব্যবস্থাতেও নারকেলগাছের প্রভাব চোখে পড়ে। নারকেলগাছ খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলের যোগাযোগব্যবস্থাকে সহজ করেছে। এ অঞ্চলে ছোট ছোট অসংখ্য নদী ও খাল রয়ে গেছে। এসব সরু নদী ও খাল পারাপারের জন্য সেতু হিসেবে নারকেলগাছের ব্যবহার দেখা যায়। আবার সাঁকো বা পুলের খুঁটি হিসেবে নারকেল কাঠের ব্যবহার চোখে পড়ে। এ ছাড়া নারকেলগাছ দিয়ে ডিঙিনৌকা তৈরি করা হয়, যা ছোট খাল ও চিংড়ি ঘেরে যাতায়াতের কাজে ব্যবহৃত হয়।
জ্বালানি হিসেবে
নারকেলের মালা, ছোবড়া, শুকনা পাতা, বাকল এ অঞ্চলের মানুষের জ্বালানির অন্যতম উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নারকেলের মালা তুষ কাঠের মতো ভালো জ্বালানি তৈরিতে সহায়তা করে। আবার এ অঞ্চলে গোবরলাঠি তৈরিতে পাটকাঠির পরিবর্তে নারকেলের লাঠি ব্যবহার দেখা যায়। গোয়ালঘরে মশা তাড়ানোর জন্য নারকেলের ছোবড়ার আগুন খুবই কার্যকরী। হুক্কার আগুনেও নারকেলের ছোবড়ার ব্যবহার লক্ষণীয়। দোকানে বা গৃহে সন্ধ্যাবেলায় ধূপসহকারে নারকেল ছোবড়ার আগুনের ধোঁয়া দেওয়ার দৃশ্য অহরহ চোখে পড়ে।
বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড
নারকেলকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে নানা প্রকার সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। যেমন নারকেল খাওয়া প্রতিযোগিতা, গাছে উঠে মুখ দিয়ে নারকেল ছুলে ফেলা ও খাওয়া প্রতিযোগিতা, ছোট অপুষ্ট নারকেলকে গুটি হিসেবে বানিয়ে বিভিন্ন ধরনের খেলা (যেমন বাঘ-ছাগল খেলা)। এ ছাড়া নারকেলের শলাকা ঘুড়ি তৈরির কাজে ব্যবহার করা হয় এবং নারকেলের ডেগো দিয়ে বাচ্চারা ক্রিকেট ব্যাট ও স্ট্যাম্প বানিয়ে থাকে। নারকেলের পাতা দিয়ে শিশুদের জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলনা যেমন পাখা, টিয়া পাখি, ফুল, ঘড়ি, চশমা, বল, নৌকা ইত্যাদি তৈরি করা হয়। আবার শিশুদের সাঁতার শিখতে ঝুনা নারকেল ব্যবহার করা হয়।
নারকেল শুধু কৃষিপণ্য নয়, খুলনাঞ্চলের মানুষের জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাস, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক রীতিনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। নারকেল এ অঞ্চলের সংস্কৃতির অন্যতম উপাদান। নারকেলের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল এ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষ। এ অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনাচারের সঙ্গে নারকেল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারকেলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই সংস্কৃতি খুলনার পরিচিতিকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। এককথায় এ অঞ্চলের মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে স্থাপিত হয়েছে নারকেলের এক নিবিড় সম্পর্ক।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।)