ছেলেটি হাউমাউ করে কান্নাকাটি করছে। সকাল সকাল এত কান্নাকাটির কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না রাহাত। গত রাতে ঝড়–বৃষ্টি হয়েছে। তাই সারারাত আবহাওয়াটা বেশ ঠান্ডা ছিল। ঠান্ডাঠান্ডা এমন আবহাওয়াতে সারা রাতের এমন মজার ঘুম এত সকালে এভাবে ভেঙ্গে যাবে, রাহাত তা এতটুকুও ভাবতে পারেনি। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে মাথাটা তখনো বেশ ঝিমঝিম করছিল। বেনজীর সাহেবের কান্নাকাটির জন্য ঘুমটা ভেঙে গেছে। কী জন্য কান্নাকাটি করছে, কী হয়েছে, পরিষ্কার করে কিছুই বলছে না! বাচ্চা ছেলের মতো কান্না করেই যাচ্ছে আর বলছে, ‘ময়নাটা মারা গেছে। ওরা সবাই চলে গেছে।’

ময়নাটা কে? তা এখনো বুঝতে পারছে না, রাহাত। বেনজীর সাহেবের বয়স প্রায় ৪৭ বছর হবে। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলে এখনো প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। মেয়ে সদ্য মাধ্যমিক বোর্ড থেকে ভালো রেজাল্ট করে উচ্চমাধ্যমিক এ ভর্তি হয়েছে। বেনজীর সাহেবের স্ত্রী স্থানীয় একটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। সে সুবাদে তাঁর মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান সবাই গ্রামে থাকেন। বেনজীর সাহেবের বদলির চাকরি। দু–তিন বছর পরপর এ শহর থেকে অন্য শহর বদলি হয় তাঁর। তাই বদলি ঝামেলা থাকায় পরিবার কখনো সঙ্গে রাখেন না। ব্যাচেলর জীবন পার করছেন দীর্ঘ চাকরি সময়। ব্যাচেলর বাসার ছোটখাট কেনাকাটা বা বাসায় কাজকাম সব নিজ হতেই করেন। দুপুরে অফিস খাওয়ার ব্যবস্থা থাকায় এতটা ঝামেলা লাগে না। অফিসে রান্না করার জন্য কাজের বুয়া নিয়োগ করা আছে। বুয়াকে সবাই খালা বলে ডাকে। বেনজীর সাহেব খালার দিয়ে রাতের তরকারি রান্না করিয়ে নেন। সকালের হালকা খাবার নিজে তৈরি করেন।  

ব্যাচেলর বাসা। বেনজীর সাহেব বাসায় একা থাকেন না। দুই রুমের ফ্ল্যাট বাসা। রেডিমেট আসবাবপত্র। পদাধিকার বলে যিনি এ অফিস থেকে অন্যত্র বদলি হয়ে যাবেন এবং বদলি–পরবর্তী যে অফিসার বা দপ্তরপ্রধান এখানে আসবেন, তিনি এ ফ্ল্যাটের সেই রুমে অস্থায়ীভাবে অধিষ্ঠিত হবেন। সাধারণত এ জায়গায় বাইরে থেকে যাঁরা আসেন, তাঁরা মূলত কেউ তাঁদের পরিবার এখানে সঙ্গে আনেন না। তাই বিবাহিত ব্যাচেলর ফ্ল্যাট বাসা তাঁদের সবচাইতে ভালো অবলম্বন। খরচখরচা গড়পড়তাই চলতে থাকে। একটুও হেরফের হয় না। বদলির সুবাদে রাহাত এ বাসায় উঠেছেন। দপ্তরপ্রধানের দায়িত্বে থাকলেও অত্র অঞ্চলের অফিসের সব সহকর্মীকে রাহাত গুরুজন মানেন। শ্রদ্ধা করেন যাঁরা তাঁর থেকে বয়সে বড় আর ছোটদের স্নেহ করেন। অফিস আদবকেতা সব কিছু ঠিকঠাক রেখে সবার সঙ্গে যে ভালোভাবে থাকা যায়, রাহাত সাহেব তার উজ্জ্বল নমুনা। বেনজীর সাহেব একজন ভালো মানুষ। রাহাত তাঁকে শুধু অফিস সহকর্মী মনে করেন না বরং সারাদিন কর্মব্যস্ত অফিসের ক্লান্ত শরীরের বাসায় ফেরার গল্প-স্বল্পর একমাত্র বন্ধু, বড় ভাই। যিনি নিজ হাতে বাজার করেন, রান্না করেন এবং রাহাতের খাওয়া দাওয়ার সব দায়িত্ব যেন তাঁর।

রাহাতের বদলির চাকরি। তথাপি তিনি কখনো পরিবার ছাড়া থাকেন না। যেখানে গিয়েছেন সেখানেই পরিবার নিয়ে গিয়েছেন। রাহাতের ১৭ বছর চাকরি জীবনে বিবাহ–পরবর্তী সময়গুলোর মধ্যে এ কয়টা মাস মনে হয় ব্যাচেলর জীবন বেছে নেওয়া। ব্যাচেলর জীবনের প্রথম সকালটা ছিল খুবই রোমাঞ্চকর, অন্যরকম। আমগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সকালের সূর্যের রাঙা আলো জানালার কাচ ভেদ করে সরাসরি রাহাতের চোখে পড়ে। হয়তো জানান দিল, সকাল হয়ে গেছে বাছা, ঘুম থেকে ওঠো। রাহাত আড়মোড়া ভেঙ্গে বিছানা ছেড়ে উঠে ব্যালকনির দরজা খুলে সরাসরি প্লাস্টিকের একটা চেয়ার পেতে ব্যালকনিতে বসল। অবাক করার বিষয়, আমগাছের ডালপালাজুড়ে শত শত রঙ–বেরঙের পাখি। এ পাতা থেকে ও পাতা, এ ডাল থেকে ও ডালে উড়ে উড়ে বসছে। ডানা ঝাপটিয়ে পাখিগুলো কিচিরমিচির করছে। না শুনলে বোঝা যাবে না।

বেনজীর সাহেব এক থালা খাবার নিয়ে ব্যালকনিতে এলেন।
-স্যার, উঠছেন!
-হ্যাঁ ভাই। কিন্তু আপনার হাতের থালায় কী?

-স্যার, দেখছেন না। আমার বাচ্চাগুলি সব খিদায় ছটফট করছে। আজ ওদের খেতে দিতে দেরি হয়ে গেল।

রাহাত বুঝল, থালাভর্তি খাবার। এগুলো পাখিদের জন্য। আর পাখিগুলো সকালে খাবার খেতে এখানে এতো জটলা জমায়। এরপর খাবারগুলো থালা থেকে হাতে নিয়ে জানালার গ্রিল দিয়ে নিচে ছিটিয়ে দিল আর টেনে টেনে সুরে সুরে বলে চলেছে, আ.... য়, আ......য়, আ.... . য়। শালিক সোনা, ময়না পাখি আয় ওই চড়ুই, আয়, আয় তোরা আয় ও ঘুঘু তোরা দূরে দূরে কেন আ.... য়, আ......য়, আ.... . য়।

স্যার, দেখছেন কি সুন্দর ঘুঘু! স্যার, ওই দ্যাখেন এক জোড়া হলুদ টিয়া। আর, ওইগুলো দোয়েল। কোয়েল আর কুজ্ঝটিকা দেখছেন স্যার কেমন খেলা করে আর খায়।
আ.... য়, আ......য়, আ.... . য়।

পাখিগুলোর মধ্যে কোনো ঝগড়া নাই, কোনো ঠোকাঠুকি নাই। কোনো পাল্লা পাল্লি বা মারামারি নাই। সবাই কী সুন্দর লেজ উঁচিয়ে উঁচিয়ে খাচ্ছে। আর শালিক তো এক পা দিয়ে লাফিয়ে চলে আর খায়। বেনজীরের হাতের থালার খাবার প্রায় শেষ। আবার রুমে ফিরে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ফিরে এলো। এবার এক বাটি কেজি মাপের প্রায় শুকনা গমজাতীয় কি সব খাবার নিয়ে এল। ছিটিয়ে দিল খাবারগুলো। কিছু পাখি উড়ে গেল, কিছু নতুন পাখি নারকেলগাছের পাতা থেকে নেমে এল। খেতে শুরু করল। কিছু পাখি যখন খাবার খেয়ে উড়ে যায় বেনজীর সাহেব তাকিয়ে থাকে ওই দূরে। তাঁর চোখ দুটি চক চক করে আনন্দে। কিছু পাখি জটলা করে খাবার খায়, আবার কিছু দূরে থেকে খাবার খায়, জটলা করে না। কিছু নতুন পাখি এক ঠোকর খাবার খায়, আবার সন্দেহ নিয়ে দূরে এদিক–সেদিক তাকায়। কী সুন্দর দৃশ্য! সব দেখে রাহাতেরও চোখ দুটি আনন্দে ভরে যায়।

শহরে ইট–পাথুরে অট্টালিকায় সকাল সকাল বাসার জন্য বাজার করা, বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে রেডি করানো, স্কুল দিয়ে আসা। বাসায় ফিরে নিজে অফিসের জন্য তৈরি হওয়া, সকালের নাশতা খেয়ে দ্রুত অফিস পানে ছুটে যাওয়া। দুরন্ত শহরে রাহাতের এগুলো ছিল নিত্য রুটিন। এ চিরাচরিত নিয়ম ছিঁড়ে বহুদিন পর একাকীত্ব এক থানা শহরের বিচিত্র এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিজেকে বেশ পুলকিত লাগছিল। প্রত্যেক সপ্তাহে শেষ দিনে পরিবারের উদ্দেশ্য ছুটে যাওয়া আর অফিস শুরুর প্রথম দিনে পরিবার ছেড়ে আসার মনোবেদনা সপ্তাহের বাকি সকালগুলো বেনজীরের পাখিপ্রেমী ভাবটা বেশ ইনজয় করে রাহাত। মাঝেমধ্যে বেনজীরের ওপর রাগ হয়, এত সকাল সকাল ঘুম থেকে ডাকার জন্য। কেননা, পাখিগুলো কিচিরমিচির শুরু করে দেয় আর বেনজীর খাবার হাতে নিজ রুমে ঘুরতে থাকে। ব্যালকনিতে যেতে হলে রাহাতের রুমের ভেতর দিয়েই যেতে হতো। তাই সে মাঝেমধ্যে ‘স্যার উঠছেন, স্যার।’ বলে সকাল সকাল চেঁচাত। প্রতি সপ্তাহের ছুটিতে রাহাত পরিবারের কাছে চলে গেলেও বেনজীর কেন যেন যেতে চাইত না। এ নিয়ে রাহাত কটুকথা বললেও, ও কিছু মনে করত না। কারণ, সে চলে গেলে শুক্র, শনি আর রোববার পাখিগুলোকে কে খেতে দেবে! তাই, কালেভদ্রে দু–এক দিন গেলেও সর্বোচ্চ এক সকালের বেশি কাটাত না। কারণ, এক সকালের খাবার সে ব্যালকনির এক কোণে খোলা রেখে যেত। যেন পাখিগুলোর খাবার কোনো সমস্যা না হয়। গত রাতে খুব ঝড়বৃষ্টি হয়েছে। সঙ্গে শিলা পড়েছে। আমগাছের ডালপালা ভেঙ্গে গেছে। হয়তো বেশ কিছু পাখি আহত হয়েছে। একটা ময়না পাখি মারা গেছে। আজ সকালে খাবার হাতে বেনজীর ব্যালকনিতে যেতেই মারা যাওয়া ময়না দেখতে পায়, তাই সে বাচ্চা ছেলের মতো কান্না করছে। আমগাছের আশপাশে আজ আর কোনো পাখি নেই। সব পাখি উড়ে গেছে। এত সকালে ছেলেটার কান্নার কারণ এটাই। তার ময়না সোনা মারা গেছে। গাছের সব পাখি উড়ে গেছে।

আমাদের সমাজে এমন আবাসস্থলহীন, নদীভাঙন, পাহাড়ি ঢলে ঘর হারানো ভাসমান মানুষগুলোও বারবার অস্থায়ী বসত গড়ে রাস্তার, রেললাইনের পাশে, নদীর পাড়ে, পাহাড়ি ঢালে একটু ভালো থাকার, একটু ভালো খাবারের আশায়। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা দুর্যোগে তাঁদের বসত ভেঙে যায়। নতুনের উদ্দেশ্য তাঁরা ছুটে যান অন্য প্রান্তে আবার, একটু নিরাপদ বসত আর ভালো থাকার আশায়। চক্রাকারভাবে তাঁদের জীবন ঘুরতে থাকে। আশা–নিরাশার দোলাচলে কতটুকুন এসব ভাসমান মানুষ ভালো থাকতে পারে!  

এর দু–তিন দিন আর বেনজীরের সঙ্গে রাহাতের ভালোমতো কোনো কথা হয়নি। ব্যালকনিতে বেনজীর প্রতিটি সকালে থালায় পাখির খাবার হাতে বসে থাকে। কিন্তু কোনো পাখি আর দেখা যায় না। কয়েক দিন পর বেনজীর সাহেব পাখির জন্য তৈরি করেছেন নিরাপদ আবাসস্থল। পাখির বসত উপযোগী মাটির তৈরি হাঁড়ি ঝুলিয়ে দিয়েছেন গাছের ডালে ডালে। পাখি ভেদে হাঁড়ির আকার ও আকৃতি ভিন্ন। গাছের ডালে ডালে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে এসব মাটির হাঁড়ি। একবুক আশা নিয়ে। আবার পাখি আসবে, উড়বে, খেলবে। বেনজীর খাবার ছিটিয়ে বলবে, আয় আয়। নিরাপদ বসত গড়ে উঠুক পাখপাখালির প্রতি গাছের ডালে। ফুলে–ফলে ভরে উঠুক সকলের আবাসস্থল।
*লেখক: ব্যাংকার ও প্রাবন্ধিক